বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র কৃষি যন্ত্রের বাজার
কৃষির আধুনিকায়নের জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সারাদেশে ৫২ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে সরকার। এই বড় বাজারের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে ভারী কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির পরিকল্পনা করছে।
বর্তমানে এসিআই মটরস, মুন্নু এগ্রোসহ হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি ভারী কৃষিযন্ত্র আমদানি করে। তবে সারাদেশে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ছোট ছোট কৃষিযন্ত্র তৈরি করছে। সরকার ভারী কৃষিযন্ত্র যেমন কম্বাইন্ড হার্ভেষ্টর, রিপার ও রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের মত যন্ত্রে অঞ্চলভেদে ৫০-৭০ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এজন্য ৩০২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদী কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২০-২১ সাল থেকে।
কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনো দেশে কৃষি যন্ত্রের বড় বাজার তৈরি হয়নি, তবে সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সারাদেশেই এসব যন্ত্রের বড় একটি বাজার তৈরি হবে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কিছু কোম্পানি বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে।
এসিআই এগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফ এইচ আনসারি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কৃষি যন্ত্রপাতিতে বাংলাদেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাজার আছে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিমাণ কৃষিযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে তার বাজার মাত্র ৩ হাজার কোটি টাকার।'
তিনি বলেন, 'কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাজার বড় হবে এবং এটি বিনিয়োগের খাত হিসেবে বিবেচিত হবে।'
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'পর্যায়ক্রমে স্থানীয়ভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি করতে চাই। বর্তমানে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তা আমরা কমিয়ে আনতে চাই। ইতোমধ্যে আমরা ইয়ানমার, টাটাসহ অনেক কোম্পানির সাথে কথা বলেছি, তাদেরকে অনুরোধ করেছি যাতে তারা বাংলাদেশে কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করে।'
এগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এসিআই মটরস ও আলিম ইন্ডাস্ট্রিজ ভারী কৃষিযন্ত্র আমদানি করছে। এর মধ্যে এসিআই জাপানের ইয়ানমার কোম্পানি থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি করে। তবে জাপানি এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে দেশে ভারী যন্ত্রপাতি তৈরির পরিকল্পনা করছে এসিআই।
এসিআই সূত্রে জানা যায়, ইয়ানমারে সঙ্গে চুক্তির জন্য এসিআই আলোচনা করছে। কারণ বিশ্বব্যপী ইয়ানমার যে ধরনের কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করে তা বাংলাদেশের ভুমির প্যাটার্নের কারণে সবগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার উপযোগী নয়। কিছুটা পরিবর্তন এনে এ যন্ত্রগুলো তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে যন্ত্রপাতি তৈরির মত যথেষ্ট প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলও বাংলাদেশে নেই।
যন্ত্র তৈরিতে এই কারগরি সহযোগিতাগুলো ইয়ানমারের কাছ থেকে এসিআই নিতে চায়। বাংলাদেশে শ্রমিকের খরচ কম হওয়ায় ইয়ানমার এদেশে কারখানা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এখানে উৎপাদিত কৃষিযন্ত্র বাংলাদেশে চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতে সরবরাহ করতে চায় বলে একটি সূত্রে জানা যায়।
তবে কত টাকা বিনিয়োগ করা হবে, কীভাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি তৈরি করা হবে সেগুলো নিয়ে আলোচনা চললেও চুড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে এসিআই ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় কারখানা তৈরির জমি খুঁজছে বলেও জানা গেছে।
এসিআই মানিকগঞ্জে হালকা কৃষি যন্ত্র তৈরির জন্য একটি অটোমেটেড কারখানা তৈরি করেছে। ডাচ সরকারের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, এফএমও, সিঙ্গাপুর ভিত্তিক এসডিআই প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে এই প্রকল্পে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
এদিকে কৃষিযন্ত্রপাতির সেক্টরে ভালো সম্ভাবনা থাকায় মুন্নু এগ্রো চলতি বছর তাদের একটি পুরনো একটি টুলস ফ্যাক্টরীতে এবছরই ছোট পরিসরে কৃষিযন্ত্র তৈরি করছে। শস্য মাড়াই যন্ত্র, রিপার ও বীজ বপনের জন্য কৃষি যন্ত্র তৈরি করছে। এই যন্ত্রগুলো তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি একটি অত্যাধুনিক কারখানা গড়ে তুলতে চায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক অবস্থায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায়।
মুন্নু এগ্রোর কোম্পানি সচিব বিনয় পাল বলেন, 'আমরা কৃষি যন্ত্রের বাজারে ভালো সাড়া পাচ্ছি। যে কারণে টুলসের ব্যবসা ছোট করে এনে কৃষিযন্ত্র তৈরিতে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছি। বড় বিনিয়োগের অর্থায়নের জন্য আমরা ঋণের চেষ্টা করছি।'
এগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আলিম ইন্ডাস্ট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলিমুল এহসান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'ছোট কৃষি যন্ত্র তৈরি করছে এমন কোম্পানি রয়েছে কয়েকশো। সরকারের উচিত এদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা। যাতে এর মধ্য থেকেও কিছু কোম্পানি বড় কৃষিযন্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন করে।'
বর্তমানে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার
চাষের জন্য জমি কর্ষণে প্রায় ৯৫ শতাংশ জমি পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়েনি ফসল লাগানো, কাটা বা মাড়াইয়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক তথ্যে দেখা গেছে, সারাদেশে ফসল লাগানোর জন্য মাত্র ১ শতাংশ জমিতে কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। আর ফসল কাটা এবং মাড়াই করার জন্য ৩ শতাংশের কিছু বেশি জমিতে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে।
এফ এইচ আনসারি বলেন, 'কৃষি যন্ত্রের মধ্যে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারেরই চাহিদা বেশি। এসব যন্ত্র বছরে প্রায় ১০ হাজার বিক্রি হয়।'
কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি যন্ত্রের আমদানিকারক ও স্থানীয় উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে কৃষি যন্ত্রপাতির বার্ষিক বাজার ৩ হাজার কোটি টাকা। ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারও এখনো আমদানি নির্ভর। তবে স্থানীয় উৎপাদকারীরা যেসব ছোট যন্ত্র তৈরি করছে তার বাজার মাত্র ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার।
২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে ২০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সারা দেশে ১৭৬২টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর, ৩৭৯টি রিপার, ৩৪টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ প্রায় ২ হাজার ৩০০টি বিভিন্ন ধরনের কৃষিযন্ত্র কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৬৮০ কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি পর্যায়ে জোরেশোরে যান্ত্রীকীকরণের জন্য গুরুত্ব বাড়ানো হয় ২০১০ সালে। এ সময় ১৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যার আওতায় যন্ত্র ক্রয়ে কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করা হয়, যখন কিনা ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের চাহিদা তৈরি হতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে 'এনহান্সমেন্ট অব ক্রপ প্রোডাকশন থ্রু ফার্ম মেকানাইজেশন প্রজেক্ট- ফেইজ টু' নামে ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছরে আরও একটি প্রকল্প শুরু করে বাস্তবায়ন করে সরকার।
এরপরও ভারী যন্ত্রের ব্যবহার খুব একটা না বাড়ার কারণ হিসেবে প্রকল্পটির সাবেক পরিচালক শেখ মো. নাজিম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'মেশিনগুলো পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকের ঘাটতি রয়েছে, একই সঙ্গে ঘাটতি রয়েছে মেশিনারিজ সার্ভিসিং এর জন্য যে ব্যকওয়ার্ড লিংকেজ দরকার তা এখনো ঠিকভাবে গড়ে উঠেনি।'
সব ধরনের ফসল চাষে জমি প্রস্তুত, বীজ লাগানো বা বোনা, পাকা ফসল মাড়াই-ঝাড়াইয়ের নানা ধাপে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে তৈরি যন্ত্র যেমন আছে তেমনি আমদানি করা ভারী যন্ত্রপাতিও রয়েছে।
পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টরের বাইরে ভারি যন্ত্র বলতে মাড়াইয়ের কাজে বিভিন্ন ধরনের থ্রেশারের ব্যবহার বাড়ছে। সারাদেশে প্রায় দেড় হাজারের মত থ্রেশার ব্যবহার হচ্ছে।
ধান কাটার যন্ত্র রিপার নামে পরিচিত। বর্তমানে রিপার ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ২২০০টির মত। ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দি করার জন্য ব্যবহার করা হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর। যার ব্যবহার মূলত শুরু হয় ২০১৬-১৭ তে। শুরুর এই বছরে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর বিক্রি হয়েছিল ৭৮টি। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় তিন হাজারের মত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর ব্যবহার হচ্ছে।
ধান রোপনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার। যার পরিচিতিমূলক ব্যবহার শুরু হয়েছিল ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। তবে এই যন্ত্রটির ব্যবহার দ্রুত বাড়েনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসেবে দেখা গেছে মাত্র ১১৪টি রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার বিক্রি হয়েছে সারাদেশে। পরবর্তীতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪টি রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
দেশে যন্ত্রপাতির বড় অংশ আসে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কম্বোডিয়া থেকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে কৃষি খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্মিলিতভাবে হিসাব করা হলে হেক্টরপ্রতি ২ কিলোওয়াট শক্তি ব্যবহার হয়, যেখানে উন্নত দেশগুলোতে ব্যবহার হচ্ছে ৪ থেকে ৬ কিলোওয়াট।