ভোক্তারা এখন ব্যয়মুখী, ইঙ্গিত দিচ্ছে টাকার প্রবাহ
মানুষের খরচ করার প্রবণতা বাড়ছে। অবকাশ যাপন বা ভ্রমণের মতো খাতে খরচ করছে মানুষ। গত কয়েক মাসে ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাসের শক্তিশালী পুনরুত্থানকেই নির্দেশ করছে নগদ প্রবাহ ও লেনদেনের বিভিন্ন সূচক।
এছাড়া মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তারা আরও বেশি খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ব্যাংকের ডিমান্ড ডিপোজিট বা চাহিদা আমানত হঠাৎ করেই নেমে এসেছে। ডিমান্ড ডিপোজিট থেকে নিয়মিত অর্থ উত্তোলন করা যায়। অন্যদিকে, জুন-সেপ্টেম্বরে ডিসপোজেবল ইনকাম বা কর পরিশোধ পরবর্তী আয় নয় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কমেছে, যা ভোক্তা ব্যয়ের শক্তিশালী পুনরুত্থানকেই নির্দেশ করছে।
গত বছর ডিমান্ড ডিপোজিট প্রায় প্রতিমাসেই ২০ শতাংশের বেশি ছিল। চলাচল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় অপ্রত্যাশিত চিকিৎসা ব্যয়ের কথা ভেবে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা বাড়ে।
ডিপোজিট ডিমান্ড বাড়ায় মহামারির সময় ব্যাংক আমানত বাড়ে।
তবে সম্প্রতি সঞ্চয় প্রবণতা কমছে। সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ। অন্যদিকে, ডিমান্ড ডিপোজিট বৃদ্ধির যে প্রবণতা ছিল সেটিও এখন নিম্নমুখী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে এক মাসে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কমেছে। অন্যদিকে, আগের মাসের তুলনায় ডিমান্ড ডিপোজিটও কমেছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকারদের মতে, মানুষের হাতে নগদ অর্থ এবং চলতি আমানত কমার কারণ মানুষ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করছে। মহামারির সময় বিভিন্ন কারণে যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি, তারাও তাদের নগদ অর্থ নিয়ে ব্যবসায় ফিরেছে।
ডিমান্ড ডিপোজিট কমায় সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
সেপ্টেম্বর মাসে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। অথচ গত বছর এই হার ১৩ শতাংশের ওপর ছিল।
মহামারির সময় সশরীরে ব্যাংক লেনদেন কমার পাশাপাশি আর্থিক নিরাপত্তার কারণে মানুষ নগদ অর্থ হাতে রেখেছিল বলে জানান ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আরফান আলী।
জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ায় খরচের ধরন বদলেছে। মানুষ এখন কেনাকাটা, অবকাশ যাপন ও ভ্রমণের পিছে খরচ করায় মানুষের হাতে নগদ অর্থ ও ডিমান্ড ডিপোজিট কমেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় বেড়েছে। ফলে মানুষ বেশি খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
কয়েক মাস ধরেই বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ হওয়ায় খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দামও বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
চাল, ডিম, ময়দা, রসুন, পেঁয়াজ, আদা এবং হলুদের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল পণ্যের দাম সেপ্টেম্বর মাসে বেড়েছে।
এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে গ্রাহকদের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত বছর একই সময় নেতিবাচক ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
তবে, গ্রাহকদের ঋণ গ্রহণের সাম্প্রতিক তথ্য এখনও প্রকাশিত না হলেও ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঋণের চাহিদা উল্লেখজনকহারে বেড়েছে। ফলে ঋণের সুদহারও বাড়ছে বলে জানান যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা ইলিয়াস উদ্দীন আহমেদ।
যমুনা ব্যাংকের উদাহরণ দিয়ে মির্জা ইলিয়াস বলেন, গত বছর ব্যাংকটি ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও চলতি বছর ঋণ গ্রহণের মাত্রা ৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
গ্রহীতারা ঋণ নিতে আগ্রাসী হয়ে উঠায় সামগ্রিকভাবেই ব্যাংকিং খাতে ঋণের গড় হার ঊর্ধ্বমুখী বলেও জানান তিনি।
যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, "গত বছর আমরা বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের জন্য ঋণসীমা বাড়ালেও কোভিডের অনিশ্চয়তায় তারা সেই সুযোগ নেননি। কিন্তু সম্প্রতি তারা ঋণ সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠায় ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।"
মানুষ এখন কেনাকাটা ও ভ্রমণে ব্যয় করছে, ডলারের দামও এখন বেশি। ফলে ভ্রমণের জন্য ভোক্তারা ব্যয় বেশি করছে সেটাও এখন পরিষ্কার বলে মন্তব্য তিনি।
এছাড়া আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণ প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে।
পোশাক শিল্প খাতের অবস্থাও এখন ভালো। উল্লেখযোগ্যহারে রপ্তানি বাড়ায় এ খাতে ঋণের চাহিদাও বাড়ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ঋণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিনিময় হার, ঋণের সুদহার, কলমানি হার এবং বন্ড হার সবই এখন ঊর্ধ্বমুখী। ফলে, ব্যাংকিং খাতে শীঘ্রই তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে বলেও তিনি অনুমান করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এক মাসে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় অর্জন করে।
জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৭.৫৯ শতাংশ। গত বছর আমদানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক।
মূল্যায়ন সংস্থা ফিচ সলিউশনস ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যক্তিগত ভোগের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিলেও আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধারে নতুন করে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশিত সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে সংস্থাটি জানায়, "কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচির অগ্রগতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে টেকসই করে তুলতে সাহায্য করবে এবং একইসঙ্গে ভোক্তা ব্যয়ও বাড়াবে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ত্বরান্বিত করতে বৈশ্বিকভাবে বেড়েছে ভোক্তা ব্যয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো বৃহদাকার দুই অর্থনীতির দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে খরচ বেড়েছে।
কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণের পর ভ্রমণ সুবিধা শিথিল হওয়ায় জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের মাঝেও খরচ করার প্রবণতা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোক্তা-ব্যয় কেন্দ্রিক। মে মাসে ভোক্তা ব্যয় ০.১ শতাংশ কমলেও জুনে ১ শতাংশ বেড়েছে।
চীনে ভোগের একটি বড় অংশই আসে খুচরা বিক্রি থেকে। অক্টোবরে খুচরা বিক্রি অপ্রত্যাশিতভাবেই আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।