কোভিডের পরে, শীতের রোগ-বালাই নিয়ে জেলা হাসপাতালগুলোতে মানুষের ভিড়
প্রতি বছরের মতো এবারও জ্বর, ফ্লু, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ শীতকালীন রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে জেলা হাসপাতালগুলো। আগাম প্রস্তুতি না নেয়া ও স্বাস্থ্য খাতের অবহেলার কারণে সিজনাল ফ্লু সামলাতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সিজনাল ফ্লু মোকাবেলায় রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে আগাম জরিপ করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে লোকবল, ওষুধ, জায়গা ও হাসপাতালের বেড প্রস্তুত রাখার পরামর্শ তাদের।
দেশের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সাবেক উপাচার্য ডা. অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "৫০ বছরেও স্বাস্থ্য খাত যদি সিজনাল ফ্লু সামলাতে হিমশিম খায় তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হবে কবে? সিজনাল ডিজিজ যেহেতু একটি বাৎসরিক সমস্যা ফলে এটিকে তো স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখতে হবে। বর্ষা আসার আগে যেমন বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়া হয়, তেমনি সিজনাল ডিজিজ মোকাবেলায়ও প্রস্তুতি রাখতে হবে। কোভিড মহামারিতে তো আমরা স্বাস্থ্য খাতের সীমাবদ্ধতা দেখেছি, এখন সংক্রমণ কম, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখন স্বাস্থ্য খাতকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।"
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, "আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বছর শীতকালে দেশে রাইনো ভাইরাস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রভাবে শ্বাসতন্ত্রের নানা মৌসুমি রোগ বাড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব রোগী সামাল দিতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় রোগীদের মেঝেতে থাকতে হয়, বেড সংকটের কারণে অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে থেকে হোমিওপ্যাথি বা অন্যান্য চিকিৎসা নেয়। অনেকে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারাও যায়। পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেই এ পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব।"
পেট ব্যথা ও জ্বর নিয়ে তিন দিন ধরে ২৫০ বেডের যশোর জেনারেল হাসপাতালের মেঝেতে ভর্তি আছেন মহেশপুর উপজেলার পুরন্দপুর গ্রামের বিনা রানী (৫৫)। শীতের মধ্যে মেঝেতে থাকতে কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে ১০ বেডের বিপরীতে শনিবার রোগী ভর্তি ছিলো ৫৩ জন। অধিকাংশ রোগীকেই বিনা রানীর মত মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
শুধু যশোর জেনারেল হাসপাতাল নয়, পাবনা, নওগাঁসহ অধিকাংশ জেলা হাসপাতাল শীতকালীন রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রায় সব হাসপাতালে বেডের তুলনায় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি আছে।
যশোর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, শয্যার সাথে জায়গা সংকটের কারণে টয়লেটের সামনেও ভর্তি থাকছে রোগী ও স্বজনেরা। ভর্তি হবার পর চিকিৎসকদের দেখা না পাওয়া, এমনকি শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
২৫০ বেডের যশোর জেনারেল হাসপাতালে শনিবার রোগী ভর্তি ছিলো ৪৮৯ জন। হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন করে নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে।
হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান জানান, যশোর জেলা বাদেও নড়াইল, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলা থেকে এই হাসপাতালে রোগী আসে। রোগীর চাপে এমন অবস্থা তৈরি হয় রোগী রাখার জন্য কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা নেই, তারপরেও কোন রোগী আসলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না।
২৫০ বেডের পাবনা জেনারেল হাসপাতালের মেঝেতে ভর্তি থাকা শাহানা খাতুন (৬৫) বলেন, "জ্বর,সর্দি, কাশি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। বেড না পাওয়ায় মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। রাতে বেশ ঠান্ডা লাগে এখানে। কিন্তু উপায় নেই, গরিব মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য তো নাই।"
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবু জাফর বলেন, "শীতের কারণে হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। হাসপাতালের ধারণক্ষমতার বাইরে রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হাসপাতালে ডাক্তার স্বল্পতার কারণে চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্যা হলেও কর্তব্যরত ডাক্তাররা ওভারটাইম ডিউটি করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে।"
২৫০ বেডের নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ১৫ বেডের শিশু ওয়ার্ডে শীতজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগ নিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৮-২০ জন শিশু ভর্তি হচ্ছে।
হাসপাতালে ভর্তি এক শিশুর মা সখিনা বিবি বলেন, "ঠান্ডায় আমার দেড় মাস বয়সী মেয়ের নিউমোনিয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তবে বেড পাইনি।"
প্রতি বছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালগুলো থেকে শীতকালীন রোগের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার এ্যান্ড কন্ট্রোল রুম।
নিয়ন্ত্রণ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে শীতজনিত রোগে ২.২৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ৪৯ জন জ্বর, শ্বাসকষ্ট এবং ডায়রিয়ায় ভুগে মারা যান।
২০২০ সালেও হাসপাতালগুলোতে শীতকালীন রোগীর সংখ্যা দুই লাখের বেশি ছিল।
কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালগুলোকে শীতকালীন রোগের তথ্য পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে এ বছরের শীতকালীন ডাটা সংগ্রহ করা শুরু হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া টিবিএসকে বলেন, "প্রত্যেক হাসপাতালে বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিভাগ হয়েছে, সেসব বিভাগে নির্দিষ্ট বেড থাকে। শীতকালে সিজনাল রোগী বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে রোগীদের মেঝেতে রাখতে হয়, এছাড়া তো কোন পথ নেই কারণ আমরা রোগী ফিরিয়ে দিতে পারিনা।"
"শুধু সিজনাল রোগী নয়, সব রোগীদের চিকিৎসা সেবা বাড়াতে ৩০ বেডের হাসপাতালকে ৫০ বেডে বা ৫০ বেডের হাসপাতালকে ১০০ বেড বা ২৫০ বেডে রূপান্তর করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ সংকট এখন অনেক কমেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, জনবল সংকট রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি।"
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন আমাদের যশোর, পাবনা ও নঁওগা প্রতিনিধি)