আশীর্বাদের ছায়া সরে যাওয়ার মূল্য!
তরতর করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। সবকিছু ভালোই চলছিল বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু সেই সুখ আর কপালে সইল না—আকাশ থেকে ধপ করে ভূপাতিত হলেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে তাকে।
তিনি আর ক্ষমতাসীন দলের সদস্য নন। বহিষ্কারের একদিন পর, শনিবার টেলিভিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হতে দেখা যায় তাকে। সেখান তিনি কাঁদতে কাঁদতে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
জাহাঙ্গীর বহিষ্কৃত হওয়ার পরপরই মেয়র হিসেবে তার দুই বছরের শাসনকালের অন্ধকার দিকগুলোর ওপর আলো ফেলতে শুরু করেছে মিডিয়া। সেই সুবাদে জনগণ এখন জাহাঙ্গীরের অন্য চেহারা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানছে।
গত দুই দিনে মূলধারার জাতীয় সংবাদপত্রগুলো জাহাঙ্গীরের অন্যায় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। অভিযোগ আছে, সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য জমির মালিককে ক্ষতিপূরণ না দিয়েই বলপূর্বক ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণ করতেন জাহাঙ্গীর। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর নাম করেও ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতেন তিনি। তার অনুসারীরা অবাধে চাঁদাবাজি চালিয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর অবৈধ উপায়ে 'বিপুল সম্পদে'র মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী একাধিকবার ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে হয়রানির কথা জানিয়েছেন, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
এরকম আরও ভূরি ভূরি অভিযোগ আছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে এবং সামনে আরও অনেক অভিযোগই আসতে পারে।
এই অন্যায়গুলোর কোনোটাই হুট করে একদিনে সংঘটিত হয়নি। কিন্তু জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করার আগ পর্যন্ত মিডিয়া এসব নিয়ে বলতে গেলে কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করেনি। আগামী দিনে তার আরও অন্যায়ের কথা প্রকাশ্যে আসতে পারে।
গাজীপুরের মেয়রের অপকর্মের খবর প্রকাশের ব্যাপারে মিডিয়া এখন কেন এত উৎসাহী হয়ে উঠেছে?
উত্তরটা সহজ। মাথার ওপর থেকে আশীর্বাদের ছায়া সরে যাওয়ায় জাহাঙ্গীর তার 'অলিখিত দায়মুক্তি' হারিয়েছেন।
গণতন্ত্রে সংসদ সদস্যরা সাধারণত দায়মুক্তি নামের এই বিশেষ সুবিধা উপভোগ করেন। এই সুবিধার সুবাদে তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের সংসদীয় ম্যান্ডেট প্রয়োগ করেন এবং নির্বিচারে রাজনৈতিক বিচারের মুখোমুখি হওয়া এড়ান। মোটের ওপর এই বিশেষ অধিকারটি সংসদের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করে।
দুর্ভাগ্যবশত, একটি ভঙ্গুর গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা এবং বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নিজেদের অন্যায় কাজ থেকে 'দায়মুক্তি' ভোগের সুযোগ পাওয়ার দাবি করেন।
জাহাঙ্গীর বোধকরি এমনই এক রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন।
জাহাঙ্গীরের জন্ম দরিদ্র কৃষক পরিবারে। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন তিনি। একচেটিয়া ব্যবসা করার জন্য তিনি ক্যাডারদের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ঝুট কাপড়ের ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন।
২০১৮ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে ধনী প্রার্থী। জাহাঙ্গীর তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ২.১৬ কোটি টাকা—যা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বাকি আট প্রার্থীর সম্মিলিত আয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।
ভাগ্য জাহাঙ্গীরকে উজাড় করে দিয়েছে। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নানা অনিয়মের নির্বাচনে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন।
সিটি করপোরেশনের শীর্ষ পদে পৌঁছতে খুব একটা সময় লাগেনি জাহাঙ্গীরের। ২০০৯ সালে তিনি গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রথম নির্বাচনের মাত্র চার বছর পর তিনি নজর দেন ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের দিকে। আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আজমতউল্লাহ খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। সেই নির্বাচনে আজমতউল্লাহ বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। আজমতউল্লাহর পরাজয়ের জন্য জাহাঙ্গীরকে দায়ী করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো তিনি সফলভাবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে 'ম্যানেজ' করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে টিকিট পান।
কিন্তু জাহাঙ্গীর বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন, রাজনীতি আসলে সাপলুডু খেলা। মই বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্যের কারণে পড়ে গেলেন সোজা সাপের মুখে।
জাহাঙ্গীর এখন অসহায়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানহানিকর মন্তব্যের দায়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হবে। দোষী প্রমাণিত হলে আইনের ২১ ধারায় তাকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাভোগ করতে হতে পারে।
এমনকি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই এলজিআরডি মন্ত্রণালয় তাকে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করতে পারে। কারণ ক্ষমতায় থাকা দলের নেতারা মনে করছেন, জাহাঙ্গীর ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন।
তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমের খবরে।
এ এক চিরচেনা গল্প। কেউ যখন ক্ষমতায় থাকে, তাকে তখন বলতে গেলে কোনো জবাবদিহির মুখোমুখিই হতে হয় না। কিন্তু একবার সেই লোকের ওপর থেকে আশীর্বাদের ছায়া সরে গেলে একের পর এক মামলায় জর্জরিত করে ফেলা হয় তাকে।
এরকম ঘটনার উদাহরণ প্রচুর। বছরের পর বছর ধরে শহরের ক্লাবগুলোতে বেআইনি জুয়ার আসর বসিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা ক্যাসিনোর রাজাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কথাই ধরা যাক। এই মানুষগুলো বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল, ছিল আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন তাদের কেউ কারাগারে, কেউ পলাতক।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) হাইকোর্টকে জানিয়েছে, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া এবং এনামুল হক আরমানসহ ১৬ ক্যাসিনো ব্যবসায়ী দেশের বাইরে প্রায় ১ হাজার ১৬৯ দশমিক ৩০ কোটি টাকা পাচার করেছেন।
বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের গল্প ছিল ভয়ংকর। বহিষ্কৃত এই যুবলীগ নেতা সুকৌশলে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তরে (পিডব্লিউডি) প্রভাব বজায় রাখতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারদের একটি 'সিন্ডিকেটে'র নেতৃত্ব দিতেন শামীম। এই সিন্ডিকেট পিডব্লিউডিতে নিয়োগ ও পদায়নকে প্রভাবিত করার জন্য টাকা দিত। নিজেকে শাসক দলের লোক পরিচয় দিয়ে 'অবৈধভাবে' সরকারি চুক্তি বাগিয়ে নিয়ে বিপুল টাকাপয়সার মালিক হয়েছেন তিনি। অবৈধ জুয়ার আসর, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযানকালে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে সাত দেহরক্ষীসহ গ্রেপ্তার করা হয় শামীমকে।
জাহাঙ্গীরের ঘটনা এবং এই জাতীয় অন্যান্য ঘটনা দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগকারী ব্যক্তিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার উদ্বেগজনক গল্পের দিকেই ইঙ্গিত করে।
সারকথা হলো, ক্ষমতায় থাকলে বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে আপনি এমন 'দায়মুক্তি' ভোগ করতে পারবেন, যা আপনার ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু যখনই আপনার ওপর থেকে কৃপাদৃষ্টি সরে যাবে, সেই মুহূর্তেই আপনি হয়ে পড়বেন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের মতো অসহায়।
লেখক: উপনির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
মূল লেখা: Cost of falling from grace