দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন কতটা যুক্তিযুক্ত?
ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে গ্রহণ করার অল্পকাল পরে ভারতীয় উপমহাদেশে চৌকিদারী আইন প্রবর্তন করা হয়। সম্ভবত সেটাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় সরকার-বিষয়ক প্রথম আইন। এর আগে মোগল সম্রাটের সময় কিংবা কোম্পানির নিজস্ব শাসন শুরু হওয়ার প্রাক্বালে বিভিন্ন প্রকার স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা ছিল; তার সুস্পষ্ট রূপরেখা সম্পর্কে কোনো তথ্য এখন আর স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৭০ সালে এই চৌকিদারী আইন প্রণয়ন করা হয়। লর্ড মেয়ো সেই আইনটি প্রবর্তন করেছিলেন। এখান থেকে স্থানীয় সরকার আইনের সূত্রপাত বলা যায়। এরপরেও স্থানীয় আইনের বিভিন্ন সংস্কার ব্রিটিশদের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের পর ভারতীয় উপমহাদেশ যখন তিনটি দেশে বিভক্ত হয়, তখন থেকে দেশটিতে তার নিজেদের সুবিধামতন নানান আইন প্রণয়ন শুরু করেন। তিনটি দেশের বর্তমান স্থানীয় সরকার আইন একেবারেই আলাদা। ভারতের স্থানীয় সরকার-বিষয়ক আইন প্রবর্তিত হয় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭৩ সংশোধনীর মাধ্যমে করা হয় সেটি। যেখানে ভারতের স্থানীয় সরকার তিন স্তরবিশিষ্ট একটি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করে। সর্বভারতীয় আঙ্গিকে এর আগে প্রথম ১৯৭৭ সালে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের জোট বাম জোট জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর এই তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কায়েম করেন। এটি হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকার ভোটগ্রহণকালে একজন ভোটার একই সময়ে এই তিন স্তরের প্রার্থীকে ভোট দেন। এই সময়ে পশ্চিম বাংলার বাম জোট সরকার প্রথম প্রতীক ব্যবহার করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত শুরু করে। যা এখন পর্যন্ত সর্বভারতীয় আঙ্গিকে কার্যকর নয়।
বাংলাদেশের নানান পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে সর্বশেষ ২০০৯ সালে বর্তমান স্থানীয় সরকার আইন এবং পরবর্তীতে ২০১৫ সালে আবার একটি সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয়, যা এখন কার্যকর। বাংলাদেশের বর্তমান আইন অনুসারে দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। আইনের আরো কতগুলো দিক আছে, যে আইনবলে বেশ কিছু অপরাধ অথবা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কিছু কার্যক্রমের সঙ্গে যদি স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচিত সদস্য জড়িত হয় তাহলে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে তাকে বরখাস্ত করতে পারবেন। নির্বাহী বিভাগের কাছে এমনি একটি ক্ষমতা রয়েছে। নির্বাহী বিভাগের পরিচালনায় ও নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হচ্ছে। এদিক বিবেচনা করলে স্থানীয় সরকার কতটা কার্যকর সে প্রশ্ন করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের পদের একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েই আসেন। বাংলাদেশের সংসদ সদস্যও একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলেই তাকে বরখাস্ত বা তার সংসদ সদস্যপদ প্রত্যাহার করা হয় না। অতীত ইতিহাস তাই আজ অবধি একমাত্র কুয়েত ঘটনায় কুয়েতে আটক সাংসদ ছাড়া আর কারোর তাৎক্ষণিক বরখাস্তের ইতিহাস পাওয়া যায় না ।
সংশোধিত ২০১৫ সালের স্থানীয় সরকার আইন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে যে আইনি ব্যবস্থা ছিল, তার মাধ্যমে অতীতের স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ হচ্ছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বর্তমান পদ্ধতিতে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করার ভেতর থেকে ব্যাপক হারে সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। সমাজের সুশাসনের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার ভেতর থেকে যে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে তা সমাজকে আরো বিভক্ত করেছে। এদিকে আমরা যদি মনোযোগী হই তাহলে দেখতে পাব প্রথম যখন ২০১৬ সনে দলীয় প্রতীক ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ঠিক সেই সময়ই দেশে দুটো জিনিস ঘটেছে: ব্যাপক সন্ত্রাস এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সরকারের দায়িত্বে যারা, যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা হয়তো বিষয়টাকে সুখকর ধরেই নিলেন। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভিন্নমত ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন কতটা সঠিক সে প্রশ্নের জবাব আজ রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলেরই দেওয়া উচিত।
বিগত নির্বাচনগুলোতে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে এবং ২০২১ সালে এই নির্বাচনে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ হতাহতের সংবাদ আমরা দেখছি তা আতঙ্কিত হওয়ার মত। যদিও রাজনীতির অনেক নেতৃত্ব বলছেন এটা নাকি খুব স্বাভাবিক! উন্নত বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা আমরা ঘটতে দেখি না। উন্নত বিশ্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও প্রতীকের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সরকারের সবগুলো নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয়। কিন্তু সেখানে মনোনয়নের কর্তৃত্ব স্থানীয় ভোটারদের কাছে রক্ষিত। ভারতের ক্ষেত্রেও তাই। ভারতের পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী কিম্বা কংগ্রেসের প্রার্থী বিজেপির প্রার্থী দলীয় ভাবে নির্ধারিত হয় না। স্থানীয় ভিত্তিতেই তা নির্ধারিত হয়। অন্তরালে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে তার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে স্থানীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন কাকে মনোনয়ন দেবেন। স্থানীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের মতো অবস্থা আর কোন দেশে আছে তা জানা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা গণতন্ত্রের জন্য কতটা কার্যকর তা অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত।
অতীত নির্বাচনের ইতিহাসগুলো যদি আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশের জন্মের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রথম হতাহতের সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৮ সালের হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা আমরা দেখতে পাই। এরপরের নির্বাচনগুলোতে দু-একটি প্রাণহানির ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেলেও উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাণহানি ছিল না। পরে উল্লেখযোগ্য হারে প্রাণহানির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ২০১৬ এবং বর্তমানে এই ২০২১ সালের নির্বাচনে। ২০১৬ নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা শতাধিক, আর এ বছর তৃতীয় দফার নির্বাচন পর্যন্ত সম্ভবত ৮৮ জন নিহত হওয়ার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করলে প্রকারান্তরে কর্তৃত্ববাদিতাই প্রতিষ্ঠিত হয়। যার পরিণাম কখনো শুভ হয় না।
বাংলাদেশের এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দকে নিয়ে নানান ঘটনা ঘটেছে। প্রভাবশালী মন্ত্রী তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ৮৮টি ইউনিয়ন কাউন্সিলে দলীয় প্রতীকবিহীন নির্বাচনে রূপান্তরিত করেছিলেন। সেখানে দলীয় প্রতীক ছাড়া সবাই নির্বাচন করেছে। তেমনি দেশের নানান প্রান্তরে এমন ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মজার বিষয়টা দেখা গেল ২০০-র ওপরে ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছে। যারা মূলত আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক, তারাও এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে এই ফলাফল প্রমাণ করে যে দলকেন্দ্রিকতা সৃষ্টির যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মধ্যে, তা দেশের মানুষ ভালোভাবে দেখছেন না। এমনকি প্রকাশ্যেই অনেক মন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। আবার একটি জেলার এমপিরা সরাসরি এই প্রতীক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন এবং তারা উম্মুক্ত নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের দেশ এখনো দলীয়ভাবে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দলীয় নির্বাচন সমাজকে ব্যাপকভাবে বিভাজিত করে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এবারকার নির্বাচনের ভেতর থেকে নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়টা নিয়ে আরও ভাবতে হবে।