নকশায় সোনার চেয়েও দামি! কণ্ঠহার, সীতাহার, টায়রা-টিকলি...সবই পাওয়া যায়!
গয়না চাই গয়না! কণ্ঠহার, কানের দুল, টায়রা-টিকলি, সীতাহার, বিছা, আংটি... কোনটা চাই? সব রকম গয়না আছে ভাকুর্তায়! রাজধানী ঢাকার যানজট পেরিয়ে সামান্য এগোলেই পাবেন এক গ্রামীণ জনপদের দেখা, যেখানে ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে গয়না শিল্প। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই কুটির শিল্পের জন্য অঞ্চলটি এতটাই বিখ্যাত যে এর ভাকুর্তা নাম বদলে হয়ে গেছে 'গয়নার গ্রাম'!
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার পেরোলেই তুরাগ নদের উপর দেখা যাবে একটি ছোট্ট লোহার সেতু। বেইলি ব্রিজ বলে পরিচিত এই সেতু থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে ভাকুর্তা ইউনিয়ন। ভাকুর্তা বাজারে পৌঁছালেই কানে আসবে কারিগরদের কাজের টুংটাং শব্দ। সকাল দশটা না পেরোতেই সকলে ব্যস্ত। সারি সারি গয়নার দোকান আর বাহারি গয়না দেখে মন ভালো না হয়ে উপায় নেই।
কিন্তু ভাকুর্তার গয়না কারিগররা মহামূল্যবান সোনা-রূপা নিয়ে কাজ করেন না। তামা বা পিতলই তাদের গয়না তৈরির মূল উপাদান। স্থানীয় দোকান থেকে ধরে নামিদামি মার্কেটে হরেকরঙা পাথর বসানো অলঙ্কার, হালফ্যাশনে যাকে আমরা ইমিটেশনের গয়না বলে থাকি, সেগুলোর যোগান দেন ভাকুর্তার কারিগরেরা।
যেভাবে শুরু
শুরুতে কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিল না। এখানকার কারিগরদের পূর্বপুরুষেরা স্বর্ণের গয়না বানানো দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। স্বর্ণের দাম যখন আকাশচুম্বী হয়ে গেল, তখন তারা রূপা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু সেই রূপার দামও এখন অনেক বেশি। অন্যদিকে তামা বা পিতলের গয়না তৈরিতে খরচ কম, তাই এগুলো জনসাধারণের হাতের নাগালে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়ও বটে!
ভাকুর্তা ইউনিয়নে মোট গ্রামের সংখ্যা ৩৬টি, যার মধ্যে ভাকুর্তা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, মোগরাকান্দা, মুশুরীখোলা, ডোমরাকান্দা, বাহেরচর, ঝাউচর, লুটের চর, চুনার চর, চাপড়া ও চাইরা গ্রামসহ ১৫-১৬টি গ্রামে রয়েছে গয়না শিল্প। এসব গ্রামের প্রায় আট হাজার নারী-পুরুষ এই শিল্পের সাথে জড়িত। এদের অনেকের কাছেই এটি তাদের জীবিকা উপার্জনের প্রধান উপায়, আবার অনেকে অন্যান্য কাজের পাশাপাশি গয়নার ব্যবসাকে বেছে নিয়েছেন। ভাকুর্তা ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী এ কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন।
কীভাবে বানান গয়না?
ভাকুর্তা বাজার ঘুরে জানা যায়, গয়না তৈরির কাঁচামাল হিসেবে তামা ও পিতল, ডাইস, চেইন ইত্যাদি ভারত থেকে আসে। বাজারের ফাতেমা জুয়েলারির স্বত্বাধিকারী মো সোহেল জানান, রাজধানীর তাঁতিবাজারের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করেন। পরে ভাকুর্তার ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে সেই কাঁচামাল কিনে এনে তাতে বিভিন্ন ছাঁচ দেন। এক কথায় গয়নার কঙ্কাল বানানোর কাজটি করে থাকেন তারা।
বাজারের প্রতিটি দোকানের ব্যবসায়ীদেরই রয়েছে নিজস্ব কারিগর। কারিগররা এসব কাঁচামাল একত্র করেন এবং নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে নান্দনিক নকশার গয়না তৈরি করেন।
গয়না তৈরির প্রথম ধাপ হিসেবে কালচে মোমের প্রলেপ দেওয়া বোর্ডের উপর কাঁচামালের প্রতিটি অংশ বসানো হয়। এই মোম আসলে এক ধরনের কালো মাটি এবং এটিও ভারত থেকে আসে। এটি দিয়ে ছাঁচ তৈরি করা হয়। গয়নার নকশা করা হয়ে গেলে এর ওপর সাদা চুনার মতো দেখতে এক ধরনের প্লাস্টার ঢালা হয়। এটি বসানোর পর ছাঁচগুলো বেরিয়ে আসে। তারপর এই গয়নাকে ঝালাই করা হয়।
ঝালাইয়ের ফলে গয়নাগুলো কালচে রঙ ধারণ করে। তখন এগুলোকে সালফার এসিড মেশানো পানিতে ৫-৬ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরিষ্কার করতে হয়। পরিষ্কার করার পর গয়নাগুলো ঝকঝকে হয়ে বেরিয়ে আসে।
ভাকুর্তার শিল্পীদের কাজ এটুকুই। ভাকুর্তার অধিকাংশ গয়না শিল্পীর কাজ গয়না পরিষ্কার করে দোকানে সাজানো পর্যন্তই শেষ। এরপর সেই গয়নাগুলো কিনে নেন ঢাকার তাঁতিবাজার, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, চাঁদনী চক, ইস্টার্ন মল্লিকা, ইস্টার্ন প্লাজাসহ আরও অনেক শহুরে দোকানে। ঢাকার বাইরে থেকেও এই গয়নাগুলোর অর্ডার আসে। যারা গয়নাগুলো কিনে নেন, তারাই এগুলো পলিশ ও রঙ করে বা পাথর বসিয়ে পরবর্তীতে বিক্রি করেন। তবে ভাকুর্তার কিছু কিছু দোকানে রেডিমেড গয়নাও বিক্রি করা হয়।
রঙ করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের রঙ ব্যবহৃত হয় বলে জানান ভাকুর্তা বাজারের ব্যবসায়ীরা। প্রথমটি হলো জিপি রঙ বা স্বর্ণের পানি ধোয়া রঙ। এই রঙ ব্যবহার করলে গয়নার উজ্জ্বলতা ও রঙ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এটির দাম বেশি। দ্বিতীয়টি হলো ডাই রঙ, যা তুলনামূলক বেশ সস্তা। ভাকুর্তা বাজারের কিছু ব্যবসায়ী নিজেরাই এই গোল্ড প্লেটিং এর কাজটি করেন এবং পুরোপুরি রেডি গয়না পাওয়া যায় তাদের কাছে।
গয়নার ডিজাইন
ভাকুর্তার গয়না কারিগরদের কাছে আধুনিক বা সাবেকি ঘরানার সব রকম নকশার গয়নাই আছে। কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বছরই গয়নার নকশায় পরিবর্তন আসছে। এমনকি কেউ চাইলে নিজের পছন্দসই নকশায় গয়না কাস্টমাইজ করেও নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য দামটা একটু বেড়ে যাবে।
ব্যবসার হাল হাকিকত
গয়না তৈরির প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় স্বভাবতই ভাকুর্তায় আপনি সাধ্যের মধ্যেই গয়না পেয়ে যাবেন। ফাতেমা জুয়েলারির মালিক মো সোহেল জানান, তার দোকানে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০ টাকার গয়না আছে। সীতাহারের দাম ৪০০ থেকে ১২০০ টাকা। বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পাইকারি দামে এসব গয়না কিনে নিয়ে যায়। তার দোকান থেকে সপ্তাহে দুবার ঢাকার বাইরে গয়না যায়। তিনি আরও বলেন, "একসঙ্গে ১৫০-২০০ গয়না গেলে লাভ থাকে। খুচরা গেলে লাভ থাকে না।"
অন্য একটি দোকানের মালিক আক্তার হোসেন জানান, তার দোকানে সবচেয়ে কম দামে আছে আংটি ২০-২৫ টাকা, নেকলেস ৬০/৭০ টাকা পিস, মানতাশা ১৪০ টাকা এবং সীতাহার ৩০০-৪০০ টাকা পিস। সুমাইয়া জুয়েলার্স এন্ড ওয়ার্কশপের মালিক মিজানুর রহমান সাধারণ গয়নার পাশাপাশি সম্পূর্ণ রেডি গয়নাও বিক্রি করেন। তার দোকানে ১০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত গয়না রয়েছে। গলার হার, সীতাহার, টিকলি, কানের দুলসহ সম্পূর্ণ এক সেট গয়না নিলে রঙের মানভেদে ৮০০-৩০০০ টাকা দাম পড়ে।
মোহাম্মদ সোহেলসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের ভাষ্যে, কারিগররা গয়না শিল্পের প্রধান। সোহেলের অধীনে বর্তমানে ৩৬ জন কারিগর কাজ করছেন। অর্ডার অনুযায়ী কারিগরদের বেতন দেন তিনি। ২০ হাজার থেকে ধরে মাসে কোনো কোনো কারিগরের বিল ৩ লাখ টাকাও আসে। তিনি জানান, ব্যবসা মন্দ গেলেও কারিগরদের ভালোমন্দ তাকে দেখতে হয়। কারণ একজন কারিগর চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন।
ভাকুর্তায় গয়না শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য শীতকাল আদর্শ সময়। এ সময় বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান বেশি হওয়ায় তাদের লাভ হয় বেশি। মাঝে করোনাকালীন বেশ মন্দা গেলেও, বেশ কয়েকজন কারিগরের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে তাদের ব্যবসা ভালোই চলছে।
আকতার হোসেন জানান, গয়না ব্যবসা থেকে বর্তমানে তার মাসিক আয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা। তিনি বলেন, "আমার এখানে পাইকারি-খুচরা, দুই রকম ক্রেতাই আসে। তবে পাইকারিই বেশি। চকবাজার থেকে আসলে একবারেই ৪০-৫০ হাজার টাকার মাল নিয়ে যায়। অনলাইন ব্যবসায়ীদের কাছেও এই গয়নার চাহিদা বেশি।"
বাদ পড়েনি দেশের নামী ব্র্যান্ডের দোকানও
দেশের সবচেয়ে বড় গয়নার রাজ্য ভাকুর্তা ইতোমধ্যেই সর্বত্র নামডাক ছড়িয়েছে। বিভিন্ন প্রধান শহরের দোকানপাট থেকে শুরু করে আড়ং, কে ক্রাফটের মতো সুপরিচিত ফ্যাশন হাউসেও পৌঁছেছে ভাকুর্তার পণ্য। তবে সেগুলোর ডিজাইন একটু আলাদা, ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। দোকানগুলোও থাকে নির্দিষ্ট।
নারীদের কর্মসংস্থান
ভাকুর্তা ইউনিয়নের নারীরাও এই স্বনামধন্য কুটির শিল্পের কাজে পিছিয়ে নন। গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে অবসর সময়টুকু কাজে লাগান তারা গয়না তৈরিতে। এদের প্রায় সবাই-ই অন্য কারিগরদের হয়ে কাজ করেন। অনেকে আবার স্বামীকে সাহায্য করতে অবসরে গয়নার কাজ করেন। দৈনিক কাজের ভিত্তিতে মজুরি পান তারা।
নিজেদের স্বর্ণের দোকানের পাশাপাশি ইমিটেশন গয়না বানিয়ে স্বামীকে সাহায্য করেন কারিগর পলি রানী রাজবংশী। তিনি শুধুই মানতাশা বানান। প্রতি পিস মানতাশা ১১০-১২০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। পাশেরই একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নেকলেসের নকশা করতে ব্যস্ত কারিগর শিল্পী রাজবংশী। তিনি বলেন, "আমি এই গয়না বানিয়ে মাসে ৫০০০-৬০০০ টাকা পাই। অর্ডার অনুযায়ী বানিয়ে দেই। একটা নেকলেসের জন্য ৩০ টাকা করে দেয়। ঘরে আজাইরা বসে থাকার চেয়ে কাজ করা ভালো, তাই গয়না বানানোর কাজ করি। নিজের হাতখরচটা উঠে যায় এতে।"
আছে শিশু গয়না শিল্পীও
শুধু স্থানীয় লোকজনই নয়, দূরদূরান্ত থেকে আগত অনেকেই নিজেদের জীবিকার অবলম্বন হিসেবে খুঁজে নিয়েছেন ভাকুর্তাকে। করোনাকালে ফুপাতো ভাইয়ের হাত ধরে গাইবান্ধা থেকে ভাকুর্তায় চলে এসেছে ১১ বছর বয়সী বালক জসীম। মহাজনের অধীনে গয়নার কাজ শিখছে সে। বর্তমানে কাজের বিনিময়ে শুধু থাকা-খাওয়ার সুবিধা পাচ্ছে জসীম। করোনার প্রকোপ কমে গেলেও বাড়িতে ফেরার বা স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। কাজ শিখে নিয়ে বছর দুয়েক বাদেই পুরোদস্তুর গয়না শিল্পী হতে আগ্রহী সে।
করোনায় ক্ষতি
করোনাকালে দেশের অধিকাংশ শিল্প খাতের মতো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাকুর্তার গয়না শিল্পও। বেচাকেনা বন্ধ থাকায় অনেকে দেনায় ডুবে গেছে, অনেকে আবার প্রচুর কারিগর ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া জানা যায়, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীরা প্রচুর গয়না কিনে স্টকে রেখেছিলেন করোনার আগে। কিন্তু দীর্ঘদিন বিক্রিবাট্টা বন্ধ থাকায় সেই গয়নাগুলোর রঙও উঠে যায়।
ফাতেমা জুয়েলারির মো সোহেল বলেন, "করোনায় আমি ১৪ লাখ টাকা লস খেয়েছি। অনেক কারিগর চলে গেছিল, এখন আবার আসছে। এখন মাসে কখনো ২০ লাখ গয়না যায়, আবার ৫/১০ লাখও যায়। তবে বর্তমানে কিছু রেডিমেড গয়না পাওয়া যাওয়ায় ভাকুর্তার গয়নার দাম এবং ক্রেতা কমে গেছে।"
নেই কোনো প্রশাসনিক সহায়তা
ভাকুর্তার এই প্রাচীন কুটির শিল্প রক্ষায় সরকারিভাবে বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, স্থানীয় প্রশাসন থেকে তারা কখনোই কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি। এমনকি ভাকুর্তায় গয়না শিল্প নিয়ে নেই কোনো সমিতিও।
কারিগর এনায়েতুল ইসলাম বলেন, "অনেকেই আমাদের কাছে এসেছিল, বলছে সাহায্য করবে কিন্তু কই কিছুই তো করলো না। কুটির শিল্প বা সরকার থেকে কোনো রকম সাহায্য আসেনা। কোনো সমিতিও নেই। কারণ কারও সাথে মতে মেলে না। যে যার মতো চলে। কিন্তু এখানে কারও সঙ্গে কারও প্রতিযোগিতা বা হিংসা নেই। যে যার মতো যতটুকু পারেন কাজ করেন।
তবে ব্যবসায়ী মো সোহেল জানান, কিছুদিন আগে সরকারি কর্মকর্তারা এ অঞ্চলে এসেছিলেন এবং করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের এবারই প্রথমবারের মতো কিছু আর্থিক সাহায্য করেছেন।
যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গয়নার রাজ্য ভাকুর্তা একদিন আন্তর্জাতিকভাবেও খ্যাতি লাভ করবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের। আপাতত নিজ ঐতিহ্যকে ধারণ করে সেই সুদিনের প্রত্যাশায়ই রয়েছেন তারা।