ওমিক্রন সংক্রমণ বাড়ার আগেই মাতৃমৃত্যু ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান গাইনোকোলজিস্টদের
বাড়িতে সন্তান প্রসব, গর্ভকালীন সেবা না নেওয়া ও কোভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে গত দেড় বছরে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় এখন মাতৃকালীন সেবা স্বাভাবিকভাবেই চলছে। তবে এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাতৃমৃত্যু কমাতে গর্ভবতী মায়েদের কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়া ও গর্ভকালীন সেবা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন গাইনি বিশেষজ্ঞরা।
প্রখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক রওশন আরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওমিক্রনের ভয় রয়েছে, তাই এখন গর্ভবতী মায়েদের আরো সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। আর মাস্কের বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবেনা। গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময় বা গর্ভবতী হলেও যেকোনো সময় কোভিড ভ্যাকসিন নিতে হবে। ভ্যাকসিন নিলে কোভিডে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুঝুঁকি কমবে।"
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় ৬০টি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন ছড়িয়েছে। ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ওমিক্রন আক্রান্ত দুজন রোগী শণাক্ত হয়েছে। এখনো দেশে ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন না হওয়ায় সংক্রমণ এখনো কম।
গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে নতুন করে কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন ৩২৯ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন।
এ নিয়ে সব মিলিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২৮,০২৮ জনে দাঁড়িয়েছে এবং কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১৫,৭৯,৩২৫ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন অনেক বেশি সংক্রামক হলেও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাই তাদের জন্য যেকোনো ভাইরাসের সংক্রমণই ঝুঁকিপূর্ণ। তারা যাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়ে সব ধরনের মাতৃকালীন সেবা পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. রাশিদা বেগম টিবিএসকে বলেন, কোভিডের ভয়াবহতা কাটিয়ে গর্ভবতী মায়েরা এখন স্বাভাবিক সময়ের মতো সেবা নিচ্ছে। ওমিক্রনের সংক্রমণ এখনো কম, তারপরও সচেতন থাকতে হবে। আমি সব গর্ভবতী মায়েদের ভ্যাকসিন নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে কোভিড পজিটিভ হলেও মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে। তাই ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বাড়লে আগের মত গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু যাতে না হয় তার জন্য এখনই সচেতন হতে হবে।
বাংলাদেশে গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যুর পেছনে বাড়িতে সন্তান প্রসব একটি প্রধান কারণ।
করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগে দেশের ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী বাড়িতেই সন্তান প্রসব করতেন। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে তা বেড়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে, জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কোভিড বিষয়ক জনস্বাস্থ্য উপদেষ্টা কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল।
তিনি আরও বলেন, গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মাত্রা সবচেয়ে হ্রাস পায়। যদিও পরবর্তী তিন মাসে সেই চিত্র বদলে গেছে, কিন্তু আগের অবস্থায় ফিরে আসতে অনেকটা সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে হাসপাতালগুলোতে ৯৬৭ জন ও ২০২০ সালে ১,১৩৩ জন মায়ের প্রসবকালীন মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৮২ জন মায়ের। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২৮ জন মারা গেছেন এপ্রিল মাসে, যখন করোনার সংক্রমণ বেশি ছিলো। এছাড়া জুলাই মাসে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারে যখন কেস বেশি ছিলো তখনও গর্ভবতী মায়েদের মৃত্যু সংখ্যা বেড়েছিলো।
২০১৬ সালে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) পরিচালিত 'বাংলাদেশে মাতৃকালীন মৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ'-এ দেখা যায়, দেশে প্রতি ১০০,০০০ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে ১৯৬ জন সন্তান প্রসবের সময় মারা যান।
জরিপে আরো দেখা যায়, রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির ফলে ৫৪ শতাংশ মাতৃকালীন মৃত্যু ঘটে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ডিরেক্টোরেট জেনারেল ডা মোহাম্মদ শরীফ টিবিএসকে বলেন, কোভিডের শুরুতে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও এখন সব স্বাভাবিক হয়েছে। ওমিক্রনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে সেবা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এবার সংক্রমণ বাড়লেও মাতৃকালীন সেবা ও ইনস্টিটিউটশনাল ডেলিভারি স্বাভাবিক সময়ের মতই থাকবে।