গওহর জান: ভারতবর্ষের প্রথম রেকর্ড আর্টিস্ট, ডজনখানেক ভাষায় পারদর্শী, সম্মানী ছিল তিন হাজার রুপি
১৯০২ সালে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারে স্থানীয় কার্যালয় খুলতে ভারতে আসেন গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেডের রেকর্ডিং প্রকৌশলী উইলিয়াম ফ্রেডরিক গেইসবার্গ। স্টুডিও খোলার উদ্দেশ্যে কলকাতায় পা রাখা এই মার্কিন সংগীতবোদ্ধা দাওয়াত পান এক বাঙালি বাবুর দরবারে। কিন্তু নৈশভোজের এই দাওয়াতে আরেক অতিথির উপস্থিতি বদলে দেয় গেইসবার্গের পুরো সফরকেই।
সেই অতিথি আর কেউ না, তৎকালীন কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী, গওহর জান। যিনি ১০টিরও বেশি ভাষা জানেন, গাইতে পারেন হিন্দুস্তানের সব ধরনের সংগীতই।
জন্মসূত্রে গওহরের নাম ছিল এইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়ার্ড। ১৮৭৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের এক ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। গওহরের বংশপরিচয়ও অনন্য। তার দাদি ছিলেন একজন হিন্দু, দাদা ব্রিটিশ। বাবা রবার্ট ইয়ার্ড ছিলেন স্থানীয় বরফকলের ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ভিক্টোরিয়া হেমিংস ব্রিটিশ পরিবারভুক্ত হলেও আদতে ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
অ্যাঞ্জেলিনার বয়স যখন মাত্র ছয়, তখনই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তার বাবা-মায়ের। মা ভিক্টোরিয়া তখন ছোট্ট অ্যাঞ্জেলিনাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন বেনারসে। সেখানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং পূর্বের নাম বদলে 'বদি মালকাজান' নামটি গ্রহণ করেন। আর কন্যার নাম দেন 'গওহর জান'।
মেয়ের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাকে সাথে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান মালকাজান। পেশায় গায়িকা মালকাজানের জায়গা হয় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে। সেখানে নবাবের ব্যক্তিগত অনুরাগিণী ও নর্তকী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
কলকাতায় এসে মালকা মেয়েকে হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। সে সময় নবাবের দরবারে আনাগোনা ছিল ভারতবর্ষের অনেক পুরোধা সংগীতজ্ঞের। তাদের সান্নিধ্যেও সংগীতচর্চা শুরু করেন গওহর।
চরণ দাসের কাছে বাংলা কীর্তন শিখেন তিনি, শিখতে শুরু করেন রবীন্দ্রসংগীতও। সংগীতের আরও নানা ধরন-ধ্রুপদ, টপ্পা, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, দাদরা, চৈতি, গজল, ধামার, বিষ্ণুপুরী এবং কাজরি গানেও পারদর্শী হতে শুরু করেন গওহর।
মা এবং পন্ডিতদের সান্নিধ্যে গান ও নাচের পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাও শিখতে শুরু করেন গওহর।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে গানের আসরে অভিষেক ঘটে গওহরের। তার প্রথম পরিবেশনাতেই বিহারের দারভাঙ্গা দরবারের কর্তারা এত মুগ্ধ হন যে কদিন পর দরবারের প্রধান সংগীত ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাকে।
ধীরে ধীরে রাজা এবং জমিদারদের মাহফিলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন গওহর। বিশেষ করে ঠুমরি গাইতে গাইতে তার নৃত্য পরিবেশন খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
একসময় কলকাতার মাহফিল ও মজলিসগুলোয় প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠেন এই গুণবতী। ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতার সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটিই হয়ে ওঠেন গওহর।
এছাড়া ভারতবর্ষের স্টেট রাজসভাগুলো থেকেও একের পর এক ডাক পেতে শুরু করেন তিনি। এমনকি রাজা পঞ্চম জর্জের রাজ্যাভিষেক উৎসবেও দিল্লি থেকে বিশেষ আমন্ত্রণ আসে গওহরের জন্য।
এদিকে রাজরাজরা ও বাবুদের কাছ থেকে দামি উপহার পেতে পেতে তার সম্পদের পরিমাণও পর্বতসম হয়ে ওঠে।
১৯০২ সালের ১১ নভেম্বর ভারতবর্ষের প্রথম রেকর্ডিং আর্টিস্ট হিসেবে ইতিহাস করেন গওহর। গ্রামোফোন কোম্পানির পক্ষ থেকে স্থানীয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করতে আসা গেইসবার্গ সেই নৈশভোজেই সিদ্ধান্ত নেন প্রথম শিল্পী হিসেবে গওহরকে সুযোগ দেওয়ার।
তবে কলকাতার তৎকালীন 'হার্টথ্রব' এত সহজে রাজি হননি। রেকর্ডিংয়ের প্রতি সেশনের জন্য তিন হাজার রুপি দাবি করেন তিনি। এবং সে দাবিতেই রাজি হয়ে যান গেইসবার্গ।
নিজের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ১০টিরও বেশি ভাষায় প্রায় ৬০০টি গান রেকর্ড করেছেন গওহর। তার গানের ভান্ডার যেমন সুবিশাল, তেমনি বৈচিত্র্যময়। 'খেয়াল'-এর মতো ভারী উচ্চাঙ্গ সংগীত যেমন রেকর্ড করেছেন এই কণ্ঠশিল্পী, তেমনি রেকর্ড করেছেন ঠুমরী, দাদরা, কাজরি, হোরি, চৈতি ও ভজনের মতো হালকা ঘরানার হিন্দুস্তানি গানগুলোও।
ছোটবেলা থেকে রাজবাড়িতে বড় হওয়া গওহরের বেশভূষা ও আচার-আচরণও ছিল বনেদি। এছাড়া বেশ বিড়ালপ্রেমী ছিলেন তিনি। কথিত আছে, একবার নিজের বিড়াল বাচ্চা প্রসব করার পর সে আনন্দে ২০ হাজার টাকার পার্টি দেন গওহর।
উচ্ছ্বসিত প্রকৃতি এবং উদ্ধত মনোভাব গওহরকে তার সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করেছে। সব সময় এমব্রয়ডারি শাড়ি এবং ভারী গহনা পরা এই শিল্পী সাজগোজে কোনো রাজরানির চেয়ে কম ছিলেন না।
গওহরের চলাফেরাও ছিল রাজরাজড়াদের মতো। কলকাতার রাস্তায় তিনি ঘুরে বেড়াতেন ঘোড়ার গাড়িতে। কিন্তু সাধারণ জনগণের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে চড়া নিষিদ্ধ ছিল তখন। তাই সরকারি বিধি অনুযায়ী, ভাইসরয়কে দিনে এক হাজার টাকা জরিমানা দিয়েই সামনে-পিছনে চারটি ঘোড়া নিয়ে কলকাতার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াতেন এই কিংবদন্তি।
কর্মজীবনে যশ-খ্যাতির শিখর দেখা গওহরের ব্যক্তিগত জীবন এতটা সুখের ছিল না। বেনারসের ছাগন রাই এবং নিমাই সেনের মতো বাবুদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে প্রণয় হলেও কেউ তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেননি। গুজরাটের বিখ্যাত অভিনেতা অমৃত কেশব নায়কের সঙ্গে বোম্বেতে সত্যিকারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও কেশবের অকালমৃত্যুতে সমাপ্তি ঘটে তারও।
একসময় ব্যক্তিগত সহকর্মী ও তবলচি সৈয়দ আব্বাসকে বিয়ে করেন গওহর। এই এক সিদ্ধান্তই তার বর্ণাঢ্য জীবনের পতন নিয়ে আসে। গওহরের চেয়ে বয়সে বেশ ছোট আব্বাস এই সম্পর্কের অপব্যবহার করেন ভয়ানকভাবে। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ও স্ত্রীর সম্পত্তি দেদারে নষ্ট করা আব্বাসের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে গিয়ে প্রায় সবকিছু হারান গওহর।
কোর্টকাছারি ও মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত আব্বাসকে দূরে সরাতে পারলেও তত দিনে প্রায় সকল সম্পত্তি হারিয়ে বসেন এই গায়িকা।
সে সময় মহীশুরের মহারাজা নলভাদি কৃষ্ণরাজা ওয়াদেয়ার গওহরকে তার রাজদরবারে সংগীতশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তত দিনে লড়াই করার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে বসেছেন গওহর।
১৯৩০ সালের ১৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মহীশুরের কেআর হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন গওহর। মৃত্যুকালে এই নিঃসঙ্গ শিল্পীর বিছানার পাশেও কেউ ছিল না।