বিসিকের আবদার ও আরো বন উজাড়
বাংলাদেশ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাহস করে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধে আন্তর্জাতিক ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করতে পারেনি। ১১৪টি দেশের নেতারা বন উজাড় রোধে চুক্তিতে সই করলেও, সেই তালিকায় নেই বাংলাদেশ। কেন বাংলাদেশ এরকম একটা জনগুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারলো না? অথচ বাংলাদেশের জন্য বন ধ্বংস বন্ধ করা এবং বন রক্ষা ও পুনরুদ্ধার করা খুব জরুরি একটি বিষয়।
বন উজাড় করা সংক্রান্ত একটি খবর চোখে পড়ার পর এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। বেশ ধারণা করতে পারছি, ব্রাজিলসহ আফ্রিকার বহু দেশ এ ঘোষণায় যুক্ত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কেন এতে সাড়া দিলো না। খবরে দেখলাম সংরক্ষিত বন উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানাতে চায় বিসিক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে ৪০০ কোটি টাকা প্রস্তাবিত বাজেটে মধুপুর শালবনের ২১৪ একর বন উজাড় করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক বানানোর আবদার জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন। (দ্য ডেইলি স্টার)
তারা নির্বোধের মতো যুক্তি দেখিয়েছে যে, দেশের সর্বশেষ সমতল বনের মধ্যে অন্যতম এই শালবন অযথা পড়ে আছে। তাই তারা এই শালবনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করতে চাইছে। দেশের অর্থনীতিতে বিসিকের ভূমিকা কতখানি, সেই আলোচনায় পরে যাচ্ছি। শুধু বলতে চাই বিসিকের যেসব ফ্ল্যাগশিপ দোকান রয়েছে, সেগুলোর অবস্থা খুব করুণ। এগুলো দেখলেই ধারণা করা যায় কতটা খুড়িয়ে চলছে এই প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তাদের এই অযৌক্তিক দাবি। মধুপুরের মতো একটি সংরক্ষিত বন কোন অধিকারে বিসিক চাইতে পারে?
আশংকার কথা হচ্ছে যে, যেহেতু বাংলাদেশ বন উজাড় বন্ধ সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, কাজেই যেকোনো ছুতায় এই শালবন উজাড় হয়েই যেতে পারে। শালবন উজাড় করে শিল্প পার্ক বানিয়ে বিসিক কী উদ্ধার করবে, সেটা না জানলেও আমরা জানি, দেশের বনভূমিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়লে বননির্ভর ১৯ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাসহ পুরো দেশই হুমকির মুখে পড়বে।
আমরা অতীতে দেখেছি পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং স্থানীয় জনগণের তীব্র আপত্তি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকায় নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। অথচ এই প্রকল্পগুলোর কারণে পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং বন ধ্বংস আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
পরিবেশ রক্ষার জন্য বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন সোচ্চার হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন দেশ যখন হারে হারে বুঝতে পারছে পরিবেশ রক্ষা করতে না পারলে ভেসে যেতে হবে। বন উজাড়, বন্য পশুপাখি সংরক্ষণ করতে না পারলে সবাইকে নিয়ে মরতে হবে, সেখানে বাংলাদেশে পাহাড় কাটা, বনভূমি ধ্বংস করে রোহিঙ্গা শিবির নির্মাণ, হাতিসহ বাঘ নিধন, সুন্দরবনে কলকারখানা নির্মাণ সবই করে চলেছি আমরা। আর তাই সারা বনাঞ্চল ধ্বংস রোধ করে এর পরিধি বাড়াতে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা প্রতিশ্রুতি দিলেও, আমরা দেইনি।
৩/৪ বছর আগে প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এক যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক-চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। পাহাড়ের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক সড়ক। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি-অবকাঠামো। এতে পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমরা দেখেছি, বৃষ্টিপাত শুরু হলে তিন পার্বত্য জেলায় একের পর এক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে এবং প্রাণহানিও হয়। পরিবেশবাদীরা বলেন, এইসব এলাকার বসবাসরত মানুষদের বাঁচাতে হলে অবশ্যই আমাদের পাহাড়, নদী ও বন রক্ষা করতে হবে। গবেষণা বলছে, ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে। আর ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে।
যারা বনের উপর নির্ভর করে জীবন চালান, তারা বন ধ্বংস করেন না। বন ধ্বংস করে তারাই, যারা এই বন উজাড় থেকে ফায়দা তুলতে চায়। বন উজাড়ের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, সম্পদ ও ক্ষমতার অসম বন্টন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি, কৃষিকাজ, নগরায়ন।
২০০৬ সালে কোনো রকম আগাম নোটিশ ছাড়াই উন্নয়নের নামে ভাগ্যকূল, কদুখোলা, সুয়ালক ও টংকাবতির পাহাড়ে যে ৭৫০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে, তাদের মধ্যে ম্রো ছাড়াও বম, চাকমা এমনকি কিছুসংখ্যক বাঙালি পরিবারও ছিল। এরপর কেউ তাদের কোনো খবর রাখেনি। শিল্প পার্ক, ইকো পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র বা হোটেল করার জন্য নৃগোষ্ঠীর মানুষকে যখন ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়, তখন সেটা হয় একধরণের অপরাধ। কারণ এর জন্য তাদের কোনরকম টাকা পয়সা দেয়া হয় না, এমনকি পুনর্বাসনও করা হয় না।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ রেকটিফাই করেন। এতে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক, যে জমি ঐতিহ্যগতভাবে ওরা ব্যবহার করে, সে জমি তাদের৷ কিন্তু এর আলোকে জাতীয় পর্যায়ে আইন বা নীতিমালা হয়নি এখনো। বঙ্গবন্ধু রেকটিফাই করে গেছেন। বাকিরা পরের কাজগুলো করেননি বলে, সেই সুযোগ গ্রহণ করছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং এসবের আলোকে আইন না থাকায় নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের ভূমি রক্ষা করতে পারছেন না।
দুই বছর আগে বনবিভাগ টাঙ্গাইলের মধুপুরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এক নারীর কলাবাগান কেটে ফেলে। মধুপুর গড় এলাকার বাসন্তী রেমা ৫০ শতাংশ জমি বংশপরম্পরায় চাষবাস করে আসছেন। অথচ বনবিভাগ ঐ জমি তাদের দাবি করে সেখানে সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নেয়। বংশ পরম্পরায় মধুপুর বনের নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা এসব জমি চাষবাস করে আসছেন। তাই এভাবে ফসলি জমিতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো ছিল অমানবিক ও অন্যায্য।
এরও বহু আগে ৬০ এর দশকে টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে পাকিস্তান সরকার একটি জাতীয় উদ্যান গড়ে তুলেছিল গারোদের ভূমিতে। বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কথা বলে এটা করা হলেও, আদতে উদ্দেশ্য ছিল নৃগোষ্ঠীর উচ্ছেদ। আর তাই ক্রমশ মধুপুর বনের প্রাকৃতিক গাছগাছালিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এবং জীববৈচিত্রও ধ্বংসের পথে। বনের আদি বাসিন্দা গারো ও কোচদের জীবন শেষ। তারা মামলার ভয়ে গৃহ ত্যাগ করে জঙ্গলে থাকছেন। মধুপুর বনের পরিবেশ ও মানুষ দুই-ই আজ বিপন্ন।
২০০৪ সালে আবার মধুপুর বনে জায়গা দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয় ইকো পার্ক তৈরির জন্য। গারো আর কোচদের সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ইকো পার্ক প্রকল্প বন্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু জমি রক্ষার সংগ্রাম তাদের চালিয়েই যেতে হচ্ছে। তাকাই পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলে রাখাইনদের দিকে, দেখবো তাদের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হওয়ার পথে। জমিজমা, মন্দির, শ্মশান, ভিটেমাটি সব দখল হয়ে গেছে। একই অবস্থা চলছে সিলেটের খাসিয়াপুঞ্জিতেও। সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন পরিকল্পনা বা সামাজিক বনায়ন পরিকল্পনা আদতে বনের ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিই করে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন।
পাহাড় ও বনকে নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করলেও, ক্রমশ রাষ্ট্র তা কেড়ে নিচ্ছে নানা কায়দায়। তাদের সাথে কোন কথা না বলে যাকে ইচ্ছা তাকেই জমির অধিকার দিয়ে দিচ্ছে। সেই কারণেই শালবনের জমি চাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে বিসিক। কোনভাবেই বিসিককে এই জমি দেয়া উচিৎ হবেনা। একে প্রতিহত করতে হবে সম্মিলিতভাবে।
এখন উন্নয়নের কথা শুনলেই নৃগোষ্ঠীর মানুষগুলো ভয় পায়। কারণ এর ফলেই তারা তাদের নিজস্ব জগত, ভিটেমাটি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার হারিয়েই চলেছেন। বন উজাড় করার মাধ্যমে আমাদের উন্নয়নের যে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, তা যদি আমরা না বদলাই, তাহলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে পুরো দেশের জন্য।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন