ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ
এখন আমাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা, টিভি সিরিজ। বর্তমান টেলিভিশনের পূর্বসূরি ছিল বায়োস্কোপ। ১৫ থেকে ১৭ শতকে ইউরোপে তুমুল জনপ্রিয় ছিল বায়োস্কোপ। সেই জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
অখণ্ড বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপের আমদানি হয় ১৮৯৬ সালে, কলকাতায়। আর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায়? এর দু-বছর পর।
ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয় ১৮৯৮ সালে, ক্রাউন থিয়েটারে। এ শহরে বায়োস্কোপ নিয়ে আসে ব্র্যাডফোর্ড কোম্পানি।
ঢাকায় বায়োস্কোপকে স্বাগত জানানো হয় বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দে। ঢাকাবাসীর সেই আনন্দ ধরা পড়েছে ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার পত্রিকা 'ঢাকা প্রকাশ'-এ ছাপা প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর খবরে। খবরটি এরকম ছিল:
'অত্ৰত্য ক্রাউন থিয়েটারে অদ্য রাত্রি হইতে এক অদ্ভুত দৃশ্য প্রদর্শিত হইবে। ব্রেডফোর্ড সিনেমেটোগ্রাফ কোম্পানী এরূপ সজীব চিত্র প্রদর্শন করিবেন যাহা দেখিয়া নিতান্ত বিস্ময় জন্মিবার সম্ভাবনা। গত বছর গ্রীক ও তুরস্কের যে ভীষণ যুদ্ধ হইয়াছে তাহা ও অন্যবিধ আশ্চৰ্য্য বিষয় যেন ঠিক কাৰ্য্যক্ষেত্রে যাইয়া প্রত্যক্ষ করিতেছি বলিয়া নাকি বোধ হইবে। আমরা আগামীবার ইহাব বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। আগামী বুধবার পর্যন্ত প্রত্যহ বাত্রি ৮ ঘটিকা হইতে এই ক্রীড়া প্রদর্শনের কথা হইইয়াছে।'
পদার্পণ করার পরই বাঙালির মন জয় করে নেয় বায়োস্কোপ। গোটা ঢাকা শহরকে মাতিয়ে রাখে ডায়মন্ড এবং ক্রাউন থিয়েটার। সেই জনপ্রিয়তা অচিরেই গোটা পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায় তখন বায়োস্কোপকে ডাকা হতো টকি বা টগিও নামে।
ক্রাউন থিয়েটার গড়ে তোলা হয়েছিল ঢাকার এক ভেঙে যাওয়া নাট্যদল 'সনাতন নাট্যসমাজ'-এর উদ্যোক্তাদের নিয়ে। ধারণা করা হয়, ক্রাউন থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯০-৯২ সালের দিকে। প্রথম দিকে ক্রাউনে থিয়েটারে সারা রাতই চলত অভিনয়। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষকরা এ ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট রাত এগারোটা পর্যন্ত অভিনয়ের সময় বেঁধে দেন।
এই ক্রাউন থিয়েটারে যে শুধু ঢাকার প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয়, তা নয়—১৮৯৩ সালে এখানেই বাংলা নাটকে অভিনেত্রী হিসেবে স্থানীয় নারীরা অভিনয় করেন।
ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর পর পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয় সে খবর। প্রথম প্রদর্শনীর পুরো বিবরণই ছাপে পত্রিকাগুলো। এখানে একটি পত্রিকার বিবরণ তুলে ধরা হলো:
'ফটোগ্রাফ ও ছায়াবাজি সকল পাঠকই ভাল দেখিয়াছেন। ফটোগ্রাফে লোকের নিশ্চল ছবি পরিলক্ষিত হয়, ছায়াবাজিতে ছবিগুলিকে একটু লাড়িয়া-চাড়িয়া দেখান যায়, কিন্তু সে লাড়িয়া-চাড়িয়া দেখানে একটু বাহাদুরী থাকিলেও ঠিক জীবিত লোকের কার্যবৎ পরিলক্ষিত হয় না। ঐ সিনেমেটোগ্রাফে যে দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তাহা অতি আশ্চর্য! অত্ৰত্য ক্রাউন থিয়েটার গৃহে কলিকাতা হইতে যে একটি কোম্পানী আসিয়া ঐ সিনেমেটোগ্রাফ প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহার একটি বিষয় আমরা সংক্ষেপে পাঠককে বলিলেই পাঠক বুঝিবেন, কি আশ্চর্য ব্যাপার!'
এরপর বায়োস্কোপের কাহিনির বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে হয়। সেখান থেকে খানিকটা তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:
'আমরা দেখিয়াছি, শ্রী শ্রীমতী ভারতেশ্বরীর ডায়মণ্ড জুবিলির মিছিল, গ্রীক-তুরস্ক যুদ্ধে তুরস্কের মুসলমান সৈন্য কর্তৃক গ্রীকদিকের স্ত্রী-পুরুষের লাঞ্ছনা ও হত্যা; গ্রীকের যুদ্ধ জাহাজ কর্তৃক তুরস্কের প্রভীষা দুর্গ অবরোধ, গ্রীকের গুপ্তচরকে ধরিয়া হত্যা করা, কুমারী ডিয়নের ৩০০ ফিট উচ্চ হইতে জলে-পতন, রুশ জারের অভিষেকোপলক্ষে জনতা, পাগল নাপিতের ভয়াবহ ক্ষৌরকাৰ্য্য, সমুদ্রে তুফান, সিংহসহ পালকের ক্রীড়া, ফ্রান্সের বড় রাস্তায় লোকদিগের গমনাগমন, ফরাসী সৈন্যের অশ্বারোহণে গমনাগমন, ফ্রান্সের রেলে লোকের যাতায়াত এবং আরও অনেক প্রকার দেখিবার যোগ্য দৃশ্য।'
পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন, ১৮৯৮ সালেই। হীরালাল প্রথমে বাংলার পথ-ঘাট, নদী, গঙ্গার ঘাটসহ বিভিন্ন মন্দিরের চিত্র সংগ্রহ করে তা বায়োস্কোপ দেখাতেন। এরপর তিনি থিয়েটারের নাটক, নাচ, গান রেকর্ড করে দেখাতে শুরু করেন। সেখান থেকেই ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনা।
পরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে বায়োস্কোপ। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে আকছারই দেখা যেত বায়োস্কোপ। আর গ্রামের মেলা তো বায়োস্কোপ ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যেত।
তবে কালের বিবর্তনে বায়োস্কোপের চল বলতে গেলে উঠেই গেছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে বায়োস্কোপ বেঁচে আছে স্রেফ সঞ্জীব চৌধুরীর জনপ্রিয় গানের মাধ্যমেই—'তোমার বাড়ির রঙের মেলায়/দেখেছিলাম বায়োস্কোপ/বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না'।
- সূত্র: ঢাকা সমগ্র ২—মুনতাসীর মামুন