লিলি কেন ঢাকার সবচেয়ে দামি ফুল?
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী ফুলের মৌসুম। সারাবছরের মাঝে এই সময়টায় ফুলের ব্যবসা জেগে উঠে। দোকানগুলোতে যেমন প্রতি পিস ১০ টাকা দামের ফুল আছে, তেমনি প্রতি পিস ১৫০ টাকা দামের ফুলও আছে। কিন্তু ফুলকে যে ভালোবাসতে জানে, তার কাছে দাম কোনো বাধা হতে পারে না।
বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে দামি ফুলের নাম লিলি ফুল। এর প্রতি পিস ১৫০ টাকা করে পড়ে। আর স্টিকসহ কিনতে গেলে পড়ে ২৫০-৩০০ টাকা।
বাহ্যিক রঙ আর বৈচিত্র্যের সাথে রয়েছে লিলির মাদকতাপূর্ণ গন্ধ – সব মিলিয়ে লিলি এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে, বৈশ্বিক ফুলের বাজারে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে চতুর্থ স্থানটি দখল করে নিয়েছে এ ফুল। আর বিশ্বব্যাপী লিলির এমন আবেদনের আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের ফুলশিল্পেও। বিদেশ থেকে আমদানির পাশাপাশি বাংলাদেশে বর্তমানে ঢাকাসহ রংপুর, যশোর, গাজীপুরের মতো বেশ কিছু জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে এই ফুল।
এই লিলি ফুল লাল, হলুদ, গোলাপী, নীল, বেগুনী বিভিন্ন রঙয়ের হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে মূলত সাদা, হলুদ, বেগুনি ও গোলাপী রঙের লিলিই বেশি দেখা যায়। এখন পর্যন্ত আলাদা আলাদা মোট ১৫ ধরনের লিলি জন্মায় এদেশে। স্টিকসহ এই ফুলটি লম্বায় হয় প্রায় এক হাত সমান। একেকটি স্টিকে থাকে প্রায় ছয় থেকে সাতটি ফুল। তাছাড়া, এর পাতাগুলো হয় ছুরির মতো ঊর্ধ্বমুখী।
রূপে গুণে যেমন এটি প্রথম, দামের দিক থেকেও লিলি সবার উপরেই আছে। শাহবাগের ভ্যালেন্টাইন্স ফ্লাওয়ারের স্বত্বাধিকারী মো আজিজুল হক বলেন, "দাম বেশি হলেও এই ফুলের চাহিদা কম নেই। যারা বোঝে এই ফুলের মর্ম তারা ঠিকই কিনে নিয়ে যায় বেশি দাম দিয়েই।"
তবে যে লিলি ফুলের কথা আমরা বলছি তা কিন্তু আসল লিলি ফুল না। প্রধানত কন্দ থেকে উৎপন্ন একধরণের গুল্মজাতীয় সপুষ্পক উদ্ভিদ লিলিয়ামই আমাদের দেশে লিলি নামে পরিচিত। তবে আসল লিলি ফুলের সঙ্গে এই পোষাকী লিলির অনেক সাদৃশ্য আছে।
পোষাকী এই লিলি ফুলটি এসেছে মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশ থেকে। তবে সারা পৃথিবীতেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে এই ফুলটি। এই ফুলের আবাসস্থল এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশ হলেও বেশি দেখা যায় চীন, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশে। যেহেতু শীতের ফুল লিলি, তাই শীতপ্রধান দেশে এর ব্যপক জনপ্রিয়তা।
বিশ্বের একেক দেশে একেক রঙের লিলির চাহিদা বেশি। যেমন ভিয়েতনামে হলুদ লিলি, জাপানে গোলাপি লিলি এবং ইউরোপের ৭০ শতাংশ লিলির চাহিদাই সাদা লিলিকে ঘিরে।
বিভিন্ন ধরনের লিলিয়াম ফুল থাকলেও উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে, এশিয়াটিক, ওরিয়েন্টাল, মারটাগন, সিউডোলিরিয়াম জাতের ফুল। আমাদের দেশে যে জাতের লিলিয়াম ফুল দেখা যায় তা আম্যারিলিস বেলাডোনা ফুল নামে পরিচিত। বেলাডোনা হলো একটি লাতিন শব্দ, যার অর্থ সুন্দরী রমণী। বিশ্বজুড়ে এ ফুলের আরও অনেক সাধারণ নাম রয়েছে- 'লাইকোরিস স্কোয়াগিজেরা', 'মেনিনাস প্যারা এ এসকোলা', 'নেকেড লেডি লিলি'।
একটি ফুলের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার সে-সব বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন রয়েছে লিলিয়াম ফুলে। একদিকে যেমন মাদকতাপূর্ণ গন্ধ, তেমন এর রূপ। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এত দাম দিয়ে ফুল কেনার দুদিন পরই ফুল শুকিয়ে ঝরে পড়ার ভয় নেই, এটি সতেজ থাকে অন্তত এক সপ্তাহ।
লিলি গাছ করা অন্যান্য ফুল গাছের চেয়ে সহজ। অনেকটা পেঁয়াজের মতো দেখতে একটি কন্দের থেকে জন্ম নেয় এই লিলি গাছ। সাধারণত কন্দ লাগানোর তিন মাস পর ফুল ফুটতে শুরু করে। সঠিক সময়ে যদি ফুল তোলা যায় তবে তা দু সপ্তাহের মতো সতেজ অবস্থায় থাকে।
তবে লিলি ফুলের ক্ষেত্রে সঠিক তাপমাত্রা খুব গুরুতবপূর্ণ। এটি সবথেকে ভালো হয় গ্রীনহাউসে, যেখানে দিনের তাপমাত্রা থাকবে ১৮-২২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং রাতের তাপমাত্রা থাকবে ১০-১৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। তাই শীতপ্রধান দেশই এই লিলিয়াম ফুলের জন্য সুবিধাজনক।
আমাদের ফুলের দোকানে যে লিলিয়ামগুলো দেখি সেগুলো চীন এবং ভারত থেকে আমদানী হয় বলে এই ফুলের দামটাও পড়ে বেশি। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশেও এর চাষ শুরু হয়েছে। তবে তা অনেক সীমিত পরিসরে।
আগারগাঁওয়ে ফ্লাওয়ার গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী মো সোহেল এ ব্যাপারে বলেন, "দেশে যেগুলো চাষ করা হয়, সেগুলো দিয়ে আমাদের পোষায় না। তাছাড়া চীনে এবং ভারত থেকে আনা ফুলগুলো সঠিকভাবে ঘরে রাখতে পারলে এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। কিন্তু দেশীয়গুলো এতদিন থাকেনা।"
গুলশানে এক নামে পরিচিত দোকানে পুষ্পনীড়ের স্বত্বাধিকারী এস আর বাবু জানান, "আমাদের দেশের ফুলগুলো যদি আমাদানী করা ফুলের চেয়ে কম মূল্যে পাই তবে হয়তো দেশীয় ফুলগুলোই কিনবো। তবে, যদি একই মূল্যে পাই তখন চীন থেকেই আনবো। কারণ চাইনিজ ফুলগুলো অনেকদিন সতেজ থাকে।"
যেখানে ফুলের দোকানে অন্য সুগন্ধি সুন্দর ফুলগুলো বেশ সাশ্রয়ী মূল্যেই পাওয়া যায়, সেখানে লিলি ফুল হয়তো অনেক গ্রাহকের নাগালেরই বাইরে। তাই এই ফুলকে শৌখিনদের ফুল বলা যায়। দামের কারণে স্বভাবতই ঢাকায় এর বড় বাজার হলো গুলশান, বনানী এবং বেইলী রোডে। শুধু বাংলাদেশ নয়, কলকাতার বাজারেও সবচেয়ে দামি ফুল লিলি।
মূলত সব লিলিই অত্যন্ত সুন্দর। অন্য অনেক ফুলের মতই লিলিরও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশ্ব ফুল বানিজ্যে লিলি ফুলের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, দামে ও পরিমানে অর্কিডের সাথে চলছে সমান তালে। বানিজ্যের দিক থেকে লিলি ফুলের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশে যেসব লিলি গ্রাহকরা কিনে থাকেন তা মূলত বিদেশি লিলি ফুল। চীন এবং ভারত থেকেই আসে মূলত। তবে সবচেয়ে বেশি আসে চীন থেকে।
আমাদের দেশে খুব বেশি ফুলের বাজার নেই। বিশ্বজুড়ে ফুলের বাজার রমরমা হলেও বাংলাদেশে এখনো সে বাজারে মাথা উঁচু করে প্রবেশ করতে পারেনি। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত ফুলফুলোর মধ্যে গোলাপই যায় মূলত।
তবে বর্ণ-বৈচিত্র্য এবং স্থায়িত্বের কথা ভেবে বাংলাদেশে এর চাহিদা অনেক। আরিফুল ইসলাম নামের একজন শাহবাগে এসেছেন বিবাহবার্ষিকীতে সঙ্গীর জন্য ফুল কিনতে। তিনি বলেন, "দামটা সতিই বেশি, তবে নিঃসন্দেহে লিলির আলাদা আভিজাত্য আছে। তাই বছরে এক দুবার প্রিয়জনকে এমন উপহার দিতে কার্পন্য করিনা।"
অনলাইন পেজ 'ফ্লাওয়ারমার্ট ডেলিভারি'র এডমিন অনিক জানান, প্রতি মাসে ৫০-৬০ টি ফুলের বাকেট বিক্রি করে থাকেন তারা।
অপর একটি অনলাইন পেজ 'ফ্লাওয়ার বিডি'র পরিচালক নাইমুল কবির ফরহাদ জানান, সাধারণত উচ্চবিত্তরাই এই ফুল কিনে থাকে। তারপরও প্রতি মাসে এই ফুল বিক্রি করে তারা ৫০ হাজারের মতো উপার্জন করছেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে লিলিয়াম চাষাবাদের উপর গবেষণা শুরু হয়। ইতোমধ্যেই গবেষকরা ফুল চাষ ও কিছু কৌশলগত সমস্যা সমাধানে, যেমন কন্দ উৎপাদনে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। উদ্ভাবন করেছেন বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় থেকে লিলিয়ামকে সুরক্ষিত রাখার পদ্ধতিও।
সাধারণত কন্দ বপনের ৯০ থেকে ১০০ দিনের মধ্যেই লিলিয়াম ফুল পাপড়ি মেলতে শুরু করে। যদি সঠিক সময়ে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে একটি ফুল ১৪-১৫ দিন পর্যন্তও সতেজ থাকে।
সাধারণত ফুল কুঁড়িতে থাকা অবস্থায় বাজারজাত করা হয়। অন্যান্য ফুলের তুলনায় ওরিয়েন্টাল লিলি চাষের উৎপাদন খরচ ও লাভ দুটোই বেশি।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ উৎপাদনের চেষ্টা করছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার দেলোয়ার হোসেইন এবং শেলি হোসেইন দম্পতি। সম্প্রতি শাইখ সিরাজের একটি প্রতিবেদনে তাদের বাণিজ্যিক লিলি উৎপাদন প্রচেষ্টার কথা উঠে আসে।
বিশ্বব্যাপী ফুল চাষ, গবেষণা ও বাজারজাতকরণের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল ফন সানটেন। নেদারল্যান্ডস ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড এবং উগান্ডায় কাজ করে।
রয়্যাল ফন সানটেন থেকে দেলওয়ার ও শেলি দম্পতি কন্দ সংগ্রহ করেছেন। বর্তমানে তারা প্রায় ১০ হাজার ওরিয়েন্টাল লিলি চাষ করছেন। দেলোয়ার দাবি করেন তিনি বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক লিলি উৎপাদনকারী।
১২ শতক জমিতে উৎপাদিত লিলি থেকে এই দম্পতি ১২ লাখ টাকা মূল্যের লিলি বিক্রির আশা করছেন।
প্রতিটি স্টিক উৎপাদনে খরচ পড়ে ৭০ টাকা। উৎপাদন ব্যয় কমানো গেলে লাভের পরিমাণও বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।
লিলি উৎপাদনের প্রধান খরচই কন্দ আমদানিতে। আমদানির সময় প্রতিটি কন্দের জন্য কোয়ারেন্টাইন ফি হিসেবে ৫ টাকা ও আরও ১০ শতাংশ ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। দেলোয়ার আশা করেন সরকারের হস্তক্ষেপে ভর্তুকি পেলে আরও অনেকে এই ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে উঠবেন। ফলে লিলির দামও কমবে।
দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাংলাদেশে রয়েছে এই ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তাই আবহাওয়া উপযোগী করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুল চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই ফুল সম্প্রসারণ করার কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে, এই ফুল রপ্তানি করে সামনের দিনগুলোতে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।