খানজাহানের বসতভিটা খননে বেরিয়ে আসছে ৬৫০ বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদের অদূরে খানজাহান আলীর (রঃ) বসতভিটা খননের পর বেরিয়ে আসছে সাড়ে ৬০০ বছর আগের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। নিদর্শনগুলো দেখতে ভিড় করছেন শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সী দর্শনার্থীরা। সুলতানি আমলে এই এলাকার ভূমির স্তরবিন্যাস, স্থাপত্যশৈলী ও কালানুক্রমিক সময় বের করাই এই খননের মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
খানজাহান আলীর (রঃ) বসতভিটায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খননকাজ শুরু করার ১০ দিনের মাথায় গত রোববার মেলে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বসতভিটার নিচে প্রাচীন আমলের মেঝে, ইটের দেওয়ালসহ সুলতানি আমলে ব্যবহৃত নানা ধরনের তৈজসপত্র পাওয়া যায়। সেগুলো দেখতে আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা।
প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে খানজাহান আলী (রঃ) এর নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদসহ ১৭টি স্থাপনাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এর মধ্যে বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা এলাকায় অবস্থিত খানজাহান আলী (রঃ) এর বসতভিটা অন্যতম।
বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরে খানজাহানের এই বসতভিটা অবহেলিত ছিল। স্থানীয়দের গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বসতভিটার ঢিবিগুলো। ২০০০ সালের পরে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর এই বসতভিটার প্রত্মতাত্ত্বিক গুরুত্ব নির্ণয়ের জন্য কয়েক দফায় খনন করে। টিন শেডের একটি সাইড অফিসও তৈরি করে তারা।
এর ধারাবাহিকতায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার নেতৃত্বে আবারও খনন কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গ্রেডের সাতজন কর্মকর্তা ও অনিয়মিত ১৪ জন শ্রমিক এই খনন কাজ ও গবেষণায় অংশগ্রহণ করছেন। ৩১ ডিসেম্বর শুরু হওয়া খনন কাজে ইতোমধ্যে মাটির নিচে ইটের দেওয়াল, সিমেন্ট ও বালুর তৈরি মেঝে, সুলতানি আমলে ব্যবহৃত মাটির তৈরি পানির পাত্র, মাটির ঢাকনাসহ নানা তৈজসপত্র ও প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে। এসব দেখতে প্রতিদিন স্থানীয় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা আসছে এই বসভিটায়। সাড়ে ৬০০ বছর আগের প্রত্নসামগ্রী দেখে খুশি তারা।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বাগমারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তিথি বলেন, "স্কুলে এসে শুনলাম খানজাহান আলী (রঃ) এর বসতভিটা খনন হচ্ছে। পুরোনো আমলের অনেককিছু পাওয়া গেছে। এখানে এসে দেখলাম সাড়ে ৬শ বছরের পুরাতন ইটের দেওয়াল ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র।"
এই বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী চাঁদনী বলেন, "বন্ধুদের সাথে এখানে খনন কাজ দেখতে এসেছি। যারা খনন করছেন, তারা আমাদের বিভিন্ন প্রত্নবস্তু দেখিয়ে ইতিহাস বললেন। কিভাবে এগুলো মাটির নিচে এসেছে তা জেনে আমাদের খুবই ভাল লেগেছে।"
চাকুরির সুবাদে রাজশাহী থেকে বাগেরহাটে আসা পার্টেক্স ফার্নিচারের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মোঃ শফিকুর রহমান বলেন, "প্রত্নতত্ত্বের উপর আমার আগে থেকেই আগ্রহ রয়েছে। এখানে খনন কাজ হচ্ছে শুনে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আসলাম। এখানে মাটির নিচের দেওয়াল ও মেঝে দেখে বুঝলাম সাড়ে ৬শ বছরের আগেও আমাদের পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস যে কত সমৃদ্ধ ছিল তা খানজাহান আমলে নির্মিত স্থাপনা দেখে বোঝা যায়।"
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাঠ পরিদর্শক আল আমিন বলেন, আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার নেতৃত্বে আমরা বিভিন্ন গ্রেডের সাতজন কর্মকর্তা এই গবেষণা কাজ করছি। এর সাথে খননের জন্য ১৪ জন অনিয়মিত শ্রমিক সকাল সাড়ে ৬টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করছে। এই কাজ খুবই সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। একটু এদিক-ওদিক বা উল্টোপাল্টা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ৩১ ডিসেম্বর শুরু হওয়া আমাদের এই খনন কাজ ৩১ জানুয়ারি শেষ হবে। এরপরেও এই বসতভিটা নিয়ে আমাদের গবেষণা চলমান থাকবে।"
বাগেরহাটের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান মোঃ যায়েদ বলেন, "আমাদের খননকাজের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভূমির স্তরবিন্যাস, স্থাপত্য শৈলি ও কালানুক্রমিক সময় বের করা। খননের মাধ্যমে পাওয়া স্থাপনা, ইট ও তৈজসপত্রসহ নানা তথ্য উপাত্ত নিয়ে আমরা গবেষণা করব। এছাড়া খননের মাধ্যমে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে রেজিস্ট্রেশন করা হবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্দেশে এসব প্রত্নবস্তু যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।