নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন: জয়ের আশায় আইভী, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান তৈমুর
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তিন দিন আগে নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণায় বক্তব্য রাখেন মেয়র পদপ্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ শহরের ১৬ নং ওয়ার্ডে গণসংযোগ করার সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, "প্রশাসন কখনো আমার হাতের মুঠোয় ছিল না, কখনও নেওয়ার চেষ্টাও করিনি। আমি সব সময় জনগণের দোরগোড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবেও বাড়তি সুবিধা পাইনি। জনগণ যেহেতু আমার পাশে আছে, আমি কেন বাড়তি সুবিধা নিতে যাব?"
আইভী জানান, তিনি জনবিচ্ছিন্ন কেউ নন। কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে সেটি নিশ্চয় প্রশাসন দেখবে। এটা তার দেখার বিষয় নয়।
তিনি আরও বলেন, "উৎসবমুখর পরিবেশে নগরবাসী ভোট দিতে যাবেন। গত দুটি সিটি নির্বাচনেও টান টান উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ভোটের দিন নগরবাসী শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিয়েছে। পরিবেশ সুন্দর ছিল।"
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে আইভী বলেন, "আমি জানি না কাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি তাদের নাম বলুক। আমি একজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানি, যাকে হেফাজতের নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আর কাকে ধরেছে, কী করেছে, সেটি আমি জানি না।"
আইভী বলেন, প্রত্যেক নির্বাচনের আগে কিছু সমস্যা হতেই পারে।
"আমি মনে করি এজন্য প্রশাসন অত্যন্ত সচেতন। তারা এগুলো দেখাশোনা করবে। আমার ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে যাবে। ভোটের সমীকরণ নৌকার দিকে যাচ্ছে। আগেও ছিল নৌকার পক্ষে, এখনও আছে। ১৬ তারিখ নৌকায় ভোট দিবে। এরপরেও তারা নৌকার পক্ষেই থাকবে।"
এদিকে নির্বাচনে নেতাকর্মীর উপর হয়রানি ও গ্রেপ্তার বন্ধে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা চাইলেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার।
তার নেতাকর্মী-সমর্থকদের হয়রানি করা বন্ধ হয়নি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, "তল্লাশির নামে যেভাবে হয়রানি করছে পুলিশ, এটা বন্ধের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করব। পাশপাশি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করছি, আমাদের ওপর পুলিশি হয়রানি করা হচ্ছে, আপনি দয়া করে এটা বন্ধ করান।"
তিনি নির্বাচন কমিশনার ও পুলিশ সুপারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন,"নির্বাচনকে আপনারা দয়া করে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।"
তৈমুর আলম অভিযোগ করেন, তার দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ তল্লাশি ও হয়রানি করছে। তার নির্বাচনী এজেন্ট ও যারা তার সমর্থনে কাজ করছেন, তাদের বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বুধবার রাতে ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ সদস্য আমার বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়েছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা তো আছেই। এখনো গায়েবি মামলার হয়রানি কাটেনি।"
নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিদেশি দূতাবাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তৈমুর বলেন, "বিদেশি দূতাবাসে যারা আছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ করব, আপনারা নির্বাচনের দিন মাঠে থাকেন। দেশি-বিদেশি মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ আপনারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তার দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হয়রানি করা হচ্ছে।"
এ প্রধান দুই প্রার্থী ১৬ তারিখের নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এসেও একে অন্যকে দোষারোপ করাতেই ব্যস্ত আছেন অনেকটা।
শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় আইভীর পক্ষে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগের অনেকে নামলেও শামীম ওসমান সমর্থীত স্থানীয় অধিকাংশ নেতাকেই দেখা যায়নি মাঠে। এছাড়া আইভীর পক্ষে ভোট না চাইলেও অনেকে নেমেছিলেন নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে।
আইভী ও তৈমুর আলমের ভোটের মাঠে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মাঝেও শেষ মুহূর্তের পথসভা, মিছিল ও শোভাযাত্রায় জমে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। বৃহস্পতিবার আইভী জনসংযোগ করেছেন ১৬ নং ওয়ার্ডে এবং তৈমুর আলম করেছেন ১১ নং ওয়ার্ডে।
বৃহস্পতিবার আইভীর পক্ষে পথসভা করেছে মহানগর ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলীয় নেতাকর্মীরাও অংশ নেন।
এদিকে হাতি প্রতীকের প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার শহরে মিছিল নিয়ে শোভাযাত্রা করেছেন। বিএনপির সাবেক এ নেতা সঙ্গে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকেই দেখা যায়।
নারায়ণগঞ্জে সিটি নির্বাচনে প্রাধান্য ব্যবসায়ীদের: সুজন
নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ব্যবসায়ী। মেয়র প্রার্থীরা হলফনামার তথ্য গোপন করেছেন, তাই তাদের প্রার্থীতাসহ বাতিল হওয়া উচিত বলে মনে করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনে ১৮৯ জন প্রার্থী। সুজন জানায়, ইসির ওয়েবসাইটে ৩ প্রার্থীর তথ্য না পাওয়ায় ১৮৬ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে তারা।
এদের মধ্যে ৭৫ দশমিক ৮১ শতাংশই ব্যবসায়ী।
এছাড়া, ৪৬ (২৪.৭৩ শতাংশ) জনের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন ছিল, ৩৬ (১৯.৩৫ শতাংশ) জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল, যেখানে ২০ (১০.৭৫ শতাংশ) জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে উভয় মামলা রয়েছে এবং অতীতেও ছিল।
বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন নিয়ে ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সুজনের নেতৃবৃন্দ।
একজন সংসদ সদস্যের আচরণ বিধি লঙ্ঘনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় বলে সিইসি'র বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে সংস্থাটি। সুজনের আশঙ্কা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ইসি'র পক্ষপাতিত্ব নির্বাচনের ফলাফল বদলে দিতে পারে।
প্রার্থীদের আয়কর বিবরণীর তথ্য প্রকাশ না করে এবং অসম্পূর্ণ হলফনামা প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ভোটারদের বঞ্চিত করছে। জনগণের স্বার্থে না কার স্বার্থে কমিশন কাজ করছে—এমন প্রশ্নও তুলেছে সংস্থাটি।
সুজনের সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার প্রার্থীদের তথ্য তুলে ধরেন। প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে সুজন বলছে, এবার উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারায়ণগঞ্জেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের প্রাধান্য বেশি। ১২ শতাংশ প্রার্থীর আয়ের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৬৫ শতাংশ প্রার্থী এসএসসি পাস করেনি।
একটি লিখিত বিবৃতিতে, দিলীপ কুমার বলেন, সাতজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে তিনজনের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল, আর তিনজন স্নাতক। বাকি তিনজনের একজন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সমতুল্য পাস করেছেন।
সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে, ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের এসএসসির নিচে যোগ্যতা ছিল।
নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
দিলীপ কুমার বলেন, বিশ্লেষণে দেখা যায় যে মোট ১৮৬ জন প্রার্থীর মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার সিংহভাগ (১২০ জন বা ৬৪ দশমিক ৫২ শতাংশ) ছিল এসএসসি পাস বা তারও নিচে। ২০১৬ এর নির্বাচনে এই হার ছিল ৭১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
সুজন জানিয়েছে, প্রার্থীরা সম্পদের যে তথ্য দিয়েছেন, তা প্রকৃত চিত্র নয়।
সংবাদ সম্মেলনে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "হলফনামায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিস্তারিত নয়। হলফনামার যে ছক, তা সঠিক নয়। এতে পরিবর্তন আনতে হবে। হলফনামাগুলো অত্যন্ত দুর্বল। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো এগুলো যাচাই–বাছাই করে দেখা। তথ্য গোপন করলে মনোনয়ন বাতিল করা। এই নির্বাচনে অনেক প্রার্থীই অনেক তথ্য দেননি। এগুলো অসম্পূর্ণ। এতে মনোনয়ন বাতিল হওয়ার কথা।"
ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে প্রার্থীদের আয়করের বিবরণী দেওয়া হয় না বলে জানায় সুজন। এই বিবরণীর জন্য নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হলেও তারা দেবে না বলে জানিয়েছে সুজনকে।
এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "এ তথ্যগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণ যেন জেনেবুঝে ভোট দিতে পারে। সব তথ্য না দিয়ে কমিশন অবশ্যই ভোটারদের বঞ্চিত করছে। এ তথ্যগুলো প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক।"
বদিউল আলম আরও বলেন, "অনেকে করের প্রত্যয়নপত্র দিয়েও পার পেয়ে গেছেন। কিন্তু এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশন হয় এদিকে নজরই দিচ্ছে না কিংবা দায়সারা গোছের কাজ করছে। মানুষকে তথ্য জানানো তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।"
কমিশন কার স্বার্থে কাজ করে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমান আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন, কিন্তু শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়—সিইসি নূরুল হুদার এমন বক্তব্যের জবাবে সুজন সম্পাদক বলেন, "আচরণবিধি লঙ্ঘনই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সিইসির বক্তব্য বোধগম্য নয়।"
তিনি আরও বলেন, একজন প্রার্থী নিজের নেতা–কর্মীদের হয়রানি, গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু ইসির ভূমিকা নেই। ইসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার মাধ্যমে এর আগে খুলনা, গাজীপুরে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন দেখা গেছে।
ভোট গ্রহণে ইভিএম এখানে দুর্বল পদ্ধতি উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "এটা দিয়ে ফলাফল যেকোনো দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু এটা কমিশনের হাতে আছে, তাই তারাও ফলাফল পাল্টে দিতে পারে।"
নারায়ণগঞ্জে অতীতের সিটি করপোরেশন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এবারের নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সুজন সম্পাদক।
সুজনের কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, "সঠিকভাবে তথ্য দেওয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নজর দেওয়া প্রয়োজন। আশা করি, এ শেষ দায়িত্ব কমিশন ভালোভাবে পালন করবে।"