আমরা ধনী কোম্পানির গরিব মালিক হতে চাই: আকিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন শেখ বশির উদ্দিন। সুযোগ থাকার পরও বিদেশ থেকে কোনো ডিগ্রি নেননি দেশে গ্রাজুয়েশন করা বশির উদ্দিন। এর আগে ১৯৮৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই স্টেশনারি পারচেস অফিসার হিসাবে কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন তিনি। চাকরি ও পড়াশোনা একসঙ্গে চালিয়ে ১৯৯৮ সালে কোম্পানির প্লানিং ডিরেক্টর নিয়োজিত হন। এরপর মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ২০০৬ সালে ৪ হাজার কোটি টাকার বিশাল এ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) বাংলাদেশের বেসরকারি খাত নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বিলিয়ন ডলার টার্নওভারের কোম্পানির তালিকায় শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয় আকিজ গ্রুপ। দেশের প্রায় সব খাতে বিনিয়োগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি টাকায় তামাক বিক্রির পর ওই অর্থ নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ করছে গ্রুপটি। তাদের নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং বর্তমান ব্যবসা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন।
আকিজ গ্রুপের বর্তমান ব্যবসা
বর্তমানে আকিজের সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্য, বস্ত্রকল, প্লাস্টিক, পাট, প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, পার্টিকেল বোর্ড, জাহাজে পণ্য পরিবহন, চা-বাগান, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। বিড়ি ও গুদামজাত বা রাখি মালের ব্যবসা থেকে আকিজ এখন ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান। গ্রুপের অধীনে রয়েছে ৩৫টি কোম্পানি। এর মধ্যে ৩০টির বেশি অপারেশনে। কিছু রয়েছে অপারেশনের অপেক্ষায়।
আকিজ গ্রুপ কয়েক দশক ধরে বছরে গড়ে ২০ শতাংশ হারে বড় হয়েছে। করোনার শুরুর দিকে ব্যবসা কিছুটা গতি হারিয়েছিল, তবে এখন আগের পর্যায়ে ফিরেছে। একইসঙ্গে নতুন করে বিনিয়োগও করছে বেশ কয়েকটি খাতে।
বশির উদ্দিন বলেন, "বাবার সময়েই বেশিরভাগ কারখানার যাত্রা শুরু। তিনি মারা যাওয়ার পর আমরা ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়িয়েছি। এখন আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ৫৫ হাজার কর্মী।"
আকিজ টোব্যাকোর বিক্রি
তামাকের মাধ্যমেই বিস্তৃত হয়েছে আকিজের ব্যবসা। ২০১৮ সালে জাপান টোব্যাকোর কাছে তামাক ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসা বিক্রি করে দেয় আকিজ। প্রায় ১২,৪০০ কোটি টাকা দিয়ে কী করেছে আকিজ?
বশির উদ্দিন বলেন, "আমি সাধারণত এসব বিষয় ডিসক্লোজ করি না। এই অর্থ দীর্ঘ সময় ধরে ধাপে ধাপে দেবে জাপান টোব্যাকো। একটা অংশ যাবে সরকারের কর হিসেবে। যে টাকা পাওয়া গেছে, তা থেকে কর দিয়ে বাকিটা নতুন ব্যবসা অধিগ্রহণ ও বর্তমান ব্যবসার সম্প্রসারণে ব্যয় করেছে আকিজ। যেমন ৭২৫ কোটি টাকায় জনতা জুট মিল কেনা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় রবিন রিসোর্স ও রবিন এমডিএফ নামে কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে।"
"আকিজ একটি ডাইভারসিফাইড (বৈচিত্র্যপূর্ণ) কোম্পানি। আমরা ব্যবসার নতুন নতুন জায়গায় যেতে চাই। এখন আমরা নির্মাণশিল্প খাতকে বড় করছি। কৃষি ও কৃষিজাত, সিরামিক এবং ফ্লোটিং গ্লাস কারখানায় বিনিয়োগ করছি। একটি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করেছি। ধীরে ধীরে নতুন নতুন খাতে আরো বিনিয়োগ হবে," যোগ করেন তিনি।
দেশের কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে বশির উদ্দিন বলেন, "পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি সরবরাহ করা কোম্পানিকে কিনে নেয় আরেকটি চীনা কোম্পানি। যদিও চীন বিশ্বে এটির সর্বাধিক উৎপাদনকারী দেশ, তারা নিজেরা বাজারজাত না করে ব্র্যান্ডের ট্রাস্টের কারণে এটি অধিগ্রহণ করে।"
"আমাদের দেশে এগ্রো-প্রসেসিংয়ের বিপুল সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি আমাদের ট্রাস্টের জায়গাটিরও অভাব রয়েছে। এখানে আমাদের একটি রেগুলেটরি বডি দরকার। আমার পণ্যটির গ্রাহকের ট্রাস্টের জন্য রেগুলেটরি বডি দরকার। রাষ্ট্রকে একটি আস্থা তৈরি করে দিতে হবে।"
দেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা বিপুল, সুযোগ কাজে লাগাতে চায় আকিজ
নিজেরা বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনার পাশাপাশি দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য সামনে ভালো সুযোগ অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
শেখ বশির উদ্দিন বলেন, "আমাদের রাস্তা খুব পরিস্কার। আমাদের জিডিপি বাড়ছে, পার ক্যাপিটাল ইনকাম বাড়ছে। ব্যক্তির আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি জায়গায় যাওয়ায় মানুষ ব্যয় করবে। আর এটিই ম্যানুফ্যাকচারারদের সুযোগ তৈরি করবে। মানুষ ব্যয় করলে তখন প্রোডাক্ট এন্ড সার্ভিসের দরকার হবেই। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও মার্কেট বড় হবে। আগামী কয়েক দশকে আমি একসাথে দুটো সুযোগই দেখছি।"
আগামী ১০ বছর পর আকিজ গ্রুপ কোন পর্যায়ে যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ বশির উদ্দিন বলেন, "কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই স্থির থাকে না। আপনাকে পেছনে অথবা সামনে এগোতে হবেই। ভুল করলে পেছাতে হবে। আমরা দশ বছর পর কোথায় যাবো, এমনটি সেভাবে ভাবিনি। তবে সব সুযোগই কাজে লাগাতে চেষ্টা করি।"
"আমাদের সক্ষমতার মধ্যে যে সুযোগই আসুক, আমরা করতে চেষ্টা করবো। আমরা চেষ্টা করি কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে। আগামীকালই কিছু করে ফেলতে হবে, এটা আমরা ভাবি না। আমরা মনে করি, আজকের চেয়ে আগামীকাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিষ্ঠান এবং বিশাল কর্মী আমাদের জন্য অনেক বড় দায়িত্ব," যোগ করেন তিনি।
ব্র্যান্ডিংয়ের পেছনে আকিজ উদ্দিনের দর্শন
আকিজ উদ্দিন যখন বিড়ি উৎপাদন করতেন, তখন বাজারে অনেক বিড়ি ছিল। তবে এখনকার মতো প্যাকেট, মুদ্রিত নাম কিংবা ব্র্যান্ড ছিল না। কিন্তু আকিজের বিড়ি সবাই চিনত। কারণ, বিড়ির সঙ্গে একটু লাল সুতা বেঁধে দিয়ে তিনি নিজের পণ্যকে আলাদা করতেন। আর এটিই ছিল প্রথম ব্র্যান্ড ভাবনা।
বশির উদ্দিন বলেন, "তখন পণ্যের উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি ছিল। তাই তৈরি করলেই বিক্রি হয়ে যেত। হাতের মুঠি হিসাবে বিড়ি বিক্রি হতো। এক পয়সা দিয়ে যার মুঠোতে যত আটত, নিয়ে যেতো। কিন্তু কে কার বিড়ি নিয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝার উপায় ছিল না।"
"বাবা বুঝতেন, আমার বিড়ির আলাদা পরিচিতি দরকার। আর এ চিন্তা থেকেই লাল সুতা বেঁধে দিলেন। এটি ব্যয়বহুল হলেও তিনি ব্র্র্যান্ডিং শুরু করেছেন। তিনি মানের দিকে নজর দিয়েছিলেন। তখন উনার বয়স ২০ এর একটু বেশি।"
"বাবা বলতেন, আকিজ যে পণ্য বানাবে, তা মানের দিক দিয়ে বাজারের শ্রেষ্ঠ হতে হবে।"
বশির উদ্দিন বলেন, "বাবা পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক ব্যবসার বদলে নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির ওপর জোর দিতেন। এতে তার খরচ বেশি পড়ত। কিন্তু সেটা ছিল ব্যবসার শক্তি। সেই কৌশলটি আকিজ এখনো ধরে রেখেছে। ব্যবসায় বিনিয়োগ বেশি দিয়ে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনই আমাদের এখনও শক্তি।"
কারখানার মেশিনারি এবং কাঁচামাল সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে পণ্যের মান
সম্প্রতি স্থাপিত আকিজ সিরামিকসের সব মেশিনারি জার্মানি থেকে নিয়ে আসা। জার্মান টেকনোলজিতেই নির্মিত হয়েছে কারখানাটি। ফ্লোটিং গ্লাস, ফ্লাওয়ার মিল, সিমেন্টের ভিআরএম (ভার্টিক্যাল রোলার মিল) সহ প্রায় সব কারখানাই ইউরোপের টেকনোলজিতে নির্মাণ করেছে কোম্পানিটি। কারখানা স্থাপনে ব্যয় বেশি হলেও এটি কোম্পানির মুনাফায় ভালো ফল দেয় বলে জানিয়েছেন শেখ বশির উদ্দিন।
তিনি বলেন, "আমরা যন্ত্রাংশের মানে প্রাধান্য দেয়ার কারণ হলো- এতে রেগুলেশন মেনে কাজ করতে হয় এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আমাদের এমন কিছু প্রজেক্ট রয়েছে, যা ভালো মানের কারণে ইউরোপের জার্নালে এসেছে। আমাদের ফ্লাওয়ার মিল দেখতে সুইজারল্যান্ড থেকে একটি টেলিভিশন টিম এসেছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ফ্লাওয়ার মিল।"
"আমরা সিমেন্ট খাতে প্রথম ভিআরএম প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। এখন দেশের সব সিমেন্ট কোম্পানি এ প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে। আমাদের ফ্লাওয়ার মিল করার পর সবাই এখানে এসেছে। আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি হওয়ার পর বাকিরা এ প্রযুক্তিতে এসেছে।
আমি যখন কোনো প্রজেক্ট করি, তখন এর ব্যয় নিয়ে চিন্তা করিনি। এটা বাবা আমাকে শিখিয়েছেন। প্রজেক্ট কম টাকায় বানালে প্রোডাক্টিভিটি বেড়ে যায়। বেশি টাকা খরচ করে ভালো মেশিনারি দিয়ে কাজ শুরু করলে রিজেক্ট প্রডাক্ট কমে যায়। উৎপাদন খরচ কমে যায়।
এশিয়ার কোনো দেশের মেশিনারি দিয়ে প্রজেক্ট বানালে রিজেক্ট রেট বেড়ে যায়। ওই সব মেশিনের ডাউন টাইমের কারণে খরচ বেড়ে যায়। অন্যদিকে কাস্টমারও ভালো প্রডাক্ট পায় না। ফলে প্রজেক্ট করার সময়ই মানটি দেখতে হয়।"
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "আমরা প্লাস্টিক পাইপের কারখানা করার সময় শুধু হ্যান্ডেলিং সেকশনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। অনেকেই এই উৎপাদন ক্ষমতার একটি কারখানার জন্য এত খরচ করে না। জার্মানির একটি কোম্পানির প্রযুক্তি এনে এটি করেছি। সৌদি আরবে একটি প্রজেক্ট দেখে এসে দেশে এটি বানিয়েছি।
ওই কারখানা করতে প্রথমদিকে ব্যয় বেশি মনে হলেও দিনশেষে আমরা লাভবান। কারণ এখানে আমার ডাউন টাইম নেই, প্রডাক্ট উৎপাদন ব্যাহত হয় না, প্রোডাক্টও বেশ ভালো। এটি আলমেটলি চিপার।"
ধনী কোম্পানির গরিব মালিক
আকিজ মূলত জিরো ডিভিডেন্ড কোম্পানি। কোম্পানির পরিচালকরা ডিভিডেন্ড নেন না। ৮০ বছর আগে কোম্পানির প্রতিষ্ঠার পর মৃত্যু পর্যন্ত আকিজ উদ্দিন কোম্পানির ডিভিডেন্ড নেননি। তার সেই ভিশন মেনেই চলছেন বর্তমান পরিচালকরা। কোম্পানির রিটেইন আর্নিংসের পুরোটাই যায় নতুন বিনিয়োগে।
বশির উদ্দিন বলেন, "আমার বাবা বলতেন, দুনিয়াতে দুই ধরনের কোম্পানি রয়েছে। একটি হলো- কোম্পানি গরিব কিন্তু মালিক বড়লোক। আবার অন্যটি হলো- কোম্পানি বড় মালিক গরিব। বাবা ছিলেন ধনী কোম্পানির গরিব মালিক। আমরাও যে খুব বিলাসী জীবনযাপন করি, তা-ও নয়। বাবা আমাদের সম্পদকে দায়িত্বের সঙ্গে নিতে শিখিয়েছেন।"
"আমরা পুরানো কোম্পানি। আমাদের আসলে অতো সম্পদের দরকার হয় না। আমরা একটু কম খরচে সেরা পণ্যটি বানানো নিয়ে চিন্তায় থাকি। উৎপাদন, বিপণনে এতো ব্যস্ত থাকতে হয়, ভোগ করার সুযোগ আসলে হয় না। এখনও আমার কাছে মনে হয় না, খুব একটা দামি গাড়ি ব্যবহার করা দরকার। আমরাও ধনী কোম্পানির গরিব মালিক থাকতে চাই। এটাই আমাদের দর্শন।"
বাবার প্রসঙ্গ তুলে বশির উদ্দিন বলেন, "আমার বাবা খুব সাধারণ মানুষ ছিলেন। উনি ১৯৭৭ সালের পর আর গাড়ি কেনেননি। ওই সময় যে মিতসুবিশি কিনেছেন, এরপর আর নিজে কিছু কেনেন নি। ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনই করে গেছেন।"
"হেঁটে গেলে বিড়ালের মতো বিনয়ের সঙ্গে হাঁটতেন। সাধারণ সুতি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতেন। সম্পদ কখনোই ওনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না", যোগ করেন বশির উদ্দিন।