তালেবানদের সঙ্গে আফগান শান্তি আলোচনায় মধ্যস্ততা করলেন যে নারী
১৯৮৯ সালে যখন সোভিয়েত সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়, তখন যুদ্ধবিধস্ত দেশে মানুষের সেবায় চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন ফৌজিয়া কোফি। কিন্তু তার সেই কৈশোরের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। কেননা এরই মধ্যে ১৯৯০-এর দশকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয় কট্টর ইসলামি শরিয়াপন্থী তালেবান।
তালেবানদের শাসনামলে আফগানিস্তানে নাগরিক জীবনের নানা ক্ষেত্র থেকে নারীরা পুরোপুরি নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। আরও অনেকের মতো তখন কপাল পোড়ে ফৌজিয়ারও। তার স্বামী তালেবানদের হাতে বন্দি হন। আর ফৌজিয়া যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন তাকেও হত্যার চেষ্টা করে তালেবানরা।
এত বৈরিতা মোকাবেলা করেও ফৌজিয়া কোফি সাহস হারাননি। তাই তো তিনি পরবর্তীকালে তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজের মানসিক দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়েছেন।
সম্প্রতি কাতারে স্বাক্ষরিত একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তির আওতায় সহিংসতা বন্ধ করার অঙ্গীকার করে তালেবান। পাশাপাশি তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্কচ্ছেদ করার শর্ত দেওয়া হয়। চুক্তির অপরপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রও কথা দিয়েছে, হামলা বন্ধ হলে তারা আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল সেনা প্রত্যাহার করবে।
এই পরিকল্পনার শর্তগুলোর মাঝে অনেক সংশয় আর আশঙ্কার জায়গা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কিছুটা শান্তির আশায় বুক বেঁধেছে দীর্ঘ চার দশকের যুদ্ধ ও সংঘাত পীড়িত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ। কারণ বিদেশি দখলদার সেনাদের হটানোই ছিল তালেবান ঘোষিত মূল লক্ষ্য।
তাই তো তালেবান-যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরেই কাবুল, জালালাবাদসহ দেশটির প্রধান প্রধান শহরে সাধারণ নাগরিকদের আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতে দেখা গেছে।
তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তৃতীয় আরেক পক্ষ ছিল আফগান সরকার। এই পক্ষকে তালেবানরা বিদেশি শক্তির ক্রীড়ানক পুতুল বলে তাদের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার চাপে পরবর্তীতে তারা আফগান সরকারের অনানুষ্ঠানিক একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়।
দেশটির নানা স্তরের বুদ্ধিজীবী, অধিকার কর্মী এবং নির্বাচনী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় এই প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনা। মস্কোতে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় অংশ নেন ফৌজিয়া কোফি এবং মানবাধিকার কর্মী লাইলা জাফারি। তালেবানসহ ৭০ জন আফগান প্রতিনিধির ওই আলোচনায় শুধু তারা দুজনই ছিলেন নারী।
যুক্তরাষ্ট্র যখন বর্তমান চুক্তির আগে কাতারে তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিল, ঠিক তারই সমান্তরালে মস্কোতে তালেবানদের সঙ্গে আফগান শান্তি পরিকল্পনার রূপরেখা নির্ধারণে আলোচনা চালাতে থাকে এই প্রতিনিধি দল।
তালেবানদের সঙ্গে মুখোমুখি ওই আলোচনার প্রথম দিনের স্মৃতিচারণ করেছেন ফৌজিয়া। তিনি বলেন, আমি তালেবানদের উদ্দেশ্যে বলেছি, 'আফগানিস্তান এখন কোনো নির্দিষ্ট এক মতবাদ নিয়ে চলতে পারে না। বরং নতুন আফগানিস্তান নির্মাণে বহুত্ববাদী দর্শনকে ধারণ করতে হবে।'
তিনি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন কিছু তালেবান প্রতিনিধি তার দিকে তাকিয়ে হবাক হয়ে যান। কেউ কেউ নোট করছিলেন তার কথা, কেউবা অন্যদিকে তাকিয়ে ফৌজিয়ার উপস্থিতি অবজ্ঞা করার চেষ্টা করছিলেন।
তালেবানদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় এ পর্যন্ত তিনবার অংশ নিয়েছেন ফৌজিয়া। কট্টরপন্থি গোষ্ঠীটির উদ্দেশ্যে নারী স্বাধীনতা এবং অধিকার নিয়েও স্পষ্ট কথা বলেছেন। আফগান শান্তি প্রক্রিয়ায় নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আহ্বানও তিনি জানান।
ফৌজিয়া জানান, নারীদের শান্তি আলোচনার কথা উল্লেখ করা মাত্রই তালেবানরা উপহাসের হাসি হেসেছে।
তালেবানদের কাছে নারী-পুরুষ সমঅধিকারও দাবি করেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে তালেবান প্রতিনিধিরা জানান, নারীরা রাষ্ট্রপতি নয়, তবে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। তবে তারা বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাবেন না।
এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত না হলেও আলোচনার নিয়ম অনুসারে সেখানে প্রতিবাদের নিয়ম ছিল না। এ কারণেই ফৌজিয়া বিষয়টি নিয়ে আর জোরাজুরি করেননি।
নারী অধিকার সম্পর্কে তালেবানের এখনকার আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা অনুসারে, নারীরা শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবেন, কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই ইসলামি আইন এবং আফগান সংস্কৃতির আওতার ভেতর থেকে তা অর্জন করতে হবে।
এই বিষয়ে বিবিসিকে ফৌজিয়া বলেন, ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ একটি। কিন্তু ইসলামি চিন্তা ও দর্শনের অসংখ্য ভাগ রয়েছে। এর মাঝে তালেবান একটি অতি-কট্টর মতাদর্শ মেনে চলে। তবে আমি বহু আলেম-ওলামা ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে ইসলামি সংস্কৃতির বহুমুখী দর্শনগুলো সম্পর্কে জেনেছি। আফগানিস্তানে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফেরাতে হলে তালেবানকেও নিজ গণ্ডির বাইরে তাকাতে হবে।