রাইস ব্র্যান অয়েলের ৩০০ কোটি টাকা বগুড়ার রপ্তানিকে আরো জোরদার করেছে
একটি বিস্ময়কর প্রবৃদ্ধি অর্জন - বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়া গত বছর বার্ষিক রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও যা মাত্র ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি ছিল। এই সাফল্য এসেছে প্রধানত রাইস ব্র্যান অয়েল (ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি ভোজ্যতেল) রপ্তানির হাত ধরে।
কৃষিপণ্যের পাশাপাশি, এই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে হালকা প্রকৌশল এবং কৃষি যন্ত্রপাতি রপ্তানি পালন করেছে দ্রুততম প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা।
এ সময়ে জেলাটির রপ্তানি পণ্যের সম্ভার ১০ থেকে ১৬টিতে উন্নীত হয়েছে। রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, আরও পণ্য তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।
বগুড়া থেকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে: সেচ পাম্প, রাইস ব্র্যান অয়েল, পাটের সুতা ও ব্যাগ, বস্তা, মাড়াই মেশিন, আলু, পোষা প্রাণী এবং বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে, সিনথেটিক চুলের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে, আলু শ্রীলঙ্কায়, পাটের ব্যাগ সিঙ্গাপুরে, গাছের চারা তুরস্কে, প্যান্ট, ভেস্ট এবং সয়াবিন নেপাল ও ভুটানে রপ্তানি করা হয়।
প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি:
গত পাঁচ বছরে রপ্তানি তালিকার রাইস ব্র্যান অয়েল, যা শুধুমাত্র গত বছর রপ্তানি হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
ভারতে রাইস ব্র্যান অয়েলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। রপ্তানিকারকরা বলছেন, উৎপাদকদের পর্যাপ্ত কাঁচামাল না থাকায় তারা অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সম্ভাব্য বাজারে প্রবেশ করতে পারেননি। ২০১৮ সালে রাইস ব্র্যান অয়েল রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি টাকা।
বগুড়ায় রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদনকারী চারটি কোম্পানি: শেরপুরে অবস্থিত মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও ওয়েস্টার্ন এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড, শাহজাহানপুরে তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এবং কাহালু উপজেলায় আল-নূর এগ্রো লিমিটেড। এই চার কোম্পানির উৎপাদিত তেলই মূলত বিদেশে রপ্তানি হয়।
গত বছর তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ১৪৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকার রাইস ব্র্যান অয়েল রপ্তানি করেছে।
কোম্পানির পরিচালক (অর্থায়ন) নাঈম হাসান রূপন জানান, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা ভোজ্যতেলটি রপ্তানি করে আসছেন। "আগে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, চীনে এই পণ্য রপ্তানি করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর হলো ভারতে এই তেলের ব্যাপক চাহিদা। দেশটিতে দিন দিন চাহিদা বাড়ছেই।"
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে তেলটি উৎপাদনের কাঁচামালের (ধানের কুঁড়া) ব্যাপক সংকট রয়েছে।
"আমাদের উৎপাদিত তেল ভালো মানের হওয়ায় চাহিদা বাড়ছে। অন্যান্য দেশেও এই তেলের চাহিদা রয়েছে"- উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে ভারতীয় একটি সংবাদপত্র ব্যবসায়িক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আগের অর্থবছরের ৭৫ হাজার টনের চেয়ে ২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতের রাইস ব্র্যান অয়েল আমদানি দ্বিগুণ হবে।
ভারতে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ টন রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদন করে।
মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেড যেভাবে রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদনে আসে:
মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার ২০০৮ সালে যশোরের নোয়াপাড়ায় একটি রাইস মিল স্থাপন করেন। তিনি ২০১০ সালের দিকে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু করেন।
এসময় তিনি দেখেন, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যাদের রাইস মিল আছে তাদের রাইস ব্র্যান অয়েল মিলও আছে। প্রতিবেশী দেশটিতে প্রায় ৪০ বছর আগে থেকেই রাইস ব্র্যান অয়েল মিল থাকলেওঁ সেভাবে তারা বাজার ধরে উঠতে পারেনি। সেখান থেকেই তিনি দেশে এমন মিল স্থাপনের আইডিয়া পান।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে উদ্যমী হন মজুমদার এবং ২০১২ সালে বগুড়ায় একটি রাইস ব্র্যান অয়েল মিল স্থাপন করেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০১৫ সাল থেকেই আমরা অশোধিত (ক্রুড) রাইস ব্র্যান অয়েল প্রধানত ভারতে রপ্তানি করছি।"
কয়েক বছরের মধ্যেই বাজার নেতৃত্ব চলে আসে মজুমদার মিলসের হাতে। চিত্ত মজুমদার বলেন, "২০১৮ সাল থেকে প্রতিবছর বগুড়া থেকে মজুমদার প্রোডাক্টস লিমিটেড সবচেয়ে বেশি রাইস ব্র্যান অয়েল রপ্তানি করে আসছে।"
তার মিল দৈনিক ১৫০-১৬০ টন তেল উৎপাদন করে, যার পুরোটাই ভারতে রপ্তানি হয়।
সয়াবিন মিল রপ্তানিও বাড়ছে:
গত বছর বগুড়া থেকে দ্বিতীয় দ্বিতীয় সর্বাধিক রপ্তানিকৃত আইটেম ছিল- পাটের বস্তা ও সুতা। যা ভারত ও সিঙ্গাপুরের বাজারে মোট ১৫০ টাকার রপ্তানি অর্জন করে। ২০২০ সালের চেয়ে যা ছিল ৩০ কোটি টাকা বেশি।
সেচপাম্পকে হটিয়ে এসময় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে সয়াবিনজাত পণ্য রপ্তানি (সয়াবিন মিল ও ডিই অয়েলড সয়াবিন মিল)। ২০২১ সালে এই রপ্তানি আয় ছিল ৩৫ কোটি টাকা।
তবে বগুড়া থেকে সয়াবিন পণ্য রপ্তানির বিগত বছরগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
বগুড়ায় তৈরি সেচপাম্পের রয়েছে সারা দেশে ব্যাপক চাহিদা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে যা বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। গতবছর বগুড়া থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা মূল্যের সেচপাম্প রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরগুলোতে আয়ের পরিমাণ প্রায় একই অঙ্কের।
রপ্তানির সাথে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার ফলে বিশ্ববাজারে ছন্দপতন ঘটেছে। পরিস্থিতি ভালো হলে বগুড়া থেকে বিভিন্ন কৃষি পণ্য রপ্তানি করে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। কারণ উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম কৃষিপ্রধান হলো বগুড়া।
বগুড়ায় উৎপাদিত আলু ব্যবসায়ীরা গত এক দশক ধরেই রপ্তানি করে আসছেন। এছাড়া, গত সাত বছর ধরে সাত বছর ধরে বাঁধাকপিও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের বাজারে যাচ্ছে। দেশের বাইরে বগুড়ার মিষ্টি কুমড়াও যাচ্ছে ক্রমাগত। বগুড়া থেকে হাতে বোণা জালি টুপিসহ আলু, বাঁধাকপি, লাউও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি সবজির আবাদ হয় শিবগঞ্জ উপজেলায়। এ কারণে এখানে উৎপাদিত সবজিই দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হয়।
শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মুজাহিদ সরকার জানান, "বগুড়া থেকে গতবছর অন্তত ১৪ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে। এবার এই মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। আর গত বছর বগুড়া থেকে শুধু বাঁধাকপি রপ্তানি করা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টন। এরমধ্যে অন্তত ৬২৩ টন বাঁধাকপি মালয়েশিয়াতে রপ্তানি হয়েছে।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বগুড়ার শিবগঞ্জের কৃষিজ পণ্য ছাড়াও শেরপুর ও কাহালু উপজেলার গ্রামীণ নারীদের তৈরি নানা ধরনের হস্তশিল্প পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি করা হয়। এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, ইতালি, নরওয়েসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও অস্ট্রেলিয়ায়।
তবে এসব পণ্য বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তালিকায় নেই। এই হিসেবে রপ্তানি আয় আরও বেশি হওয়ার কথা।
সেচ পাম্প উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানির জন্যও বগুড়ার সুনাম রয়েছে।
বগুড়ার রপ্তানিকারকরা বলছেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে সেচ পাম্প তৈরির জন্য হাজার হাজার ছোট-বড় ফাউন্ড্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। এসব ফাউন্ড্রিকে কেন্দ্র করে শহরের গোহাইল ও স্টেশন রোডে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রের বড় বাজার। ২০০০ সালের দিকে এই সেচপাম্পের মাধ্যমেই পণ্য রপ্তানির যাত্রা শুরু করে বগুড়া।
বর্তমানে কিছু রপ্তানিকারক বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছেন। অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার থেকেও সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছেন। এখন ভারত, মালয়েশিয়া ছাড়াও বগুড়ার পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়ায়।
বগুড়ায় তৈরি পাটজাত পণ্য বস্তা, চট, সুতলি আর সুতার চাহিদা ভারতে বেশি। এসব পাটপণ্য হাসান জুট মিলস, বগুড়া জুট মিলস লিমিটেড ও মা ট্রেডার্স রপ্তানি করে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাইরে বিশেষ করে ভারতে বগুড়ার তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু চলমান করোনাভাইরাস মহামারির কারণে রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়েছে।
এছাড়া কাঁচা পাটের দাম বেশি থাকায় এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও জানান তারা।
কৃষি অধিদপ্তরের মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১.৫ লাখ সেচপাম্পের প্রয়োজন। সেচপাম্প রপ্তানির জন্য ভারত একটি বড় বাজার। বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানাগুলোও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করে।
গত বছর শুধু ভারতে ১৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প ও যন্ত্রাংশ রপ্তানি করেছে রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং।
এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মতিন সরকার বলেন, সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পাম্প বগুড়ায় তৈরি করা হয়। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমাদের স্বল্প-সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে ব্যবসা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারব। তাহলে আরও নতুন নতুন উদ্যোক্তারাও পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতে পারবেন।"
গত বছরে শুধু শ্রীলঙ্কাতে ২ কোটি ৩ লাখটাকার আলু রপ্তানি করেছে রায়হান ট্রেডার্স। এর মালিক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, বগুড়ার চেয়ে বিদেশে রংপুর ও ঠাকুরগাঁয়ের আলুর চাহিদা বেশি।
তিনি বলেন, "বিদেশে আলু বড় বাজার হতে পারে ব্রুনাই ও বাহরাইন। এই বিষয়টি মাথায় রেখে কৃষি দপ্তরকে কাজ করতে হবে।"
বগুড়ার রপ্তানি ঝুড়িতে এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে বিভিন্ন প্রকার গাছের চারা বিক্রি। বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের সদস্য সাতভাই ডটকম নামক অনলাইন একটি নার্সারি প্রথমবারের মতো তুরস্কে ৬ লাখ ৫৩ হাজার টাকার আম, লিচুসহ কয়েক প্রজাতির গাছ রপ্তানি করেছে।
সাতভাই ডটকমের মালিক শরিফুল ইসলাম কল্লোল বলেন, "চট্টগ্রাম থেকে জাহাজের মাধ্যমে এসব গাছ পাঠানো হচ্ছে বিদেশি গ্রাহকের কাছে। বিশ্বে চারার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আগামীতে আমাদের ফল, ফুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা বড় পরিসরে রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে।"
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, বগুড়া উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র। বগুড়ায় তৈরি অনেক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। বগুড়া বিমানবন্দর হলে এই অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। তখন পাল্টে যাবে এ অঞ্চলের চিত্র। আরও সচল হবে অর্থনীতির চাকা।