ভিটাকোলা ও পাংখা বরফের দিনগুলি…
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে এখন চোখের সামনে। সে কতরকম স্মৃতি আমার, কখনো হাসির, কখনো আনন্দের, কখনো চোখ ভিজে যাবার আরও কত কী। কয়েকদিন ধরে একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ছে আর সাধ জাগছে, আরেকবার সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে। তেমন একটা শিলংয়ের মেঘের গল্প।
মেঘ নেমেছে!
আমি একবারই ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম শিলংয়ে। আমরা যে বাড়িতে গিয়ে উঠতাম সেটি ছিল টিলার ওপরে। আমরা যেমন বৃষ্টি নামলে দরজা-জানালা বন্ধ করে কাপড়চোপড় ভিতরে নিয়ে আসি, শিলংয়ে এই কাজটা করতে দেখতাম মেঘ নামলে।
শিলং এমনিতেই পাহাড়ি অঞ্চল, প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এখানে। আর আমাদের বাড়িটি যেহেতু টিলার ওপর ছিল, তাই প্রায়ই মেঘ ঢুকে পড়তো ঘরের ভিতর। আর তখন আমার মা 'মেঘ মেঘ' বলে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতো, যেন মেঘের পানিতে ভিজে না যায়। মেঘ নেমে আসলেই চারদিকে হৈচৈ পড়ে যেত, 'মেঘ মেঘ' বলে। আমরা দৌড়ে গিয়ে জানালা বন্ধ করতাম। খুব মজা পেতাম আসলে তখন।
দু'বোতল সোডা খাওয়ার আবদার...
আজকাল তো এই সোডার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই, কিন্তু এটি ছিল সেভেন আপ, স্প্রাইট এসবের মতোই সফট ড্রিংক। ওটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম মিষ্টি পানীয় খাওয়ার অভিজ্ঞতা। যে বোতলগুলোতে বিক্রি হতো, সেগুলো দেখতেও ছিল বেশ মজার। একটা মার্বেলের মতো শক্ত জিনিস দিয়ে বোতলের মুখগুলো আটকানো থাকতো। ঐ মার্বেল খোলার জন্য, একধরনের লাঠির মতো থাকতো। সেটা দিয়ে চাপ দিলে, মার্বেলটা নিচে চলে যেত এবং সোডা ভুসভুস করে উপরে উঠতো। বুদবুদ থেমে গেলে, আমরা চুমুক দিয়ে খেতাম। আমার মনে আছে, বাবা আমাদের জন্য সোডা কিনে নিয়ে আসতেন।
সেসময় ওখানে প্রচুর ইংরেজ বসতি ছিল। একবার দেখলাম, একজন সর্দারজী এবং একজন ইংরেজ এসে দোকানে বসলো, আর ওদেরকে দুই বোতল সোডা খেতে দিলো। আমি তো এক বোতলই খেতে পারতাম না পুরোপুরি। কিন্তু ওদের দেখাদেখি শখ হলো দুই বোতল খাওয়ার। তাই যেদিন ফিরে যাবো তার আগেরদিন বাবা দোকানে নিয়ে গেলেন, আর দোকানদারকে বললেন আমাকে দু'বোতল সোডা দিতে। আমি এক বোতল খেয়ে শেষ করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু দ্বিতীয় বোতলটা আর পারিনি। পারবো-ই বা কী করে? বয়স তখন চার কি পাঁচ। ছোটো মানুষ, চোখের খিদে থেকেই দুটো খাওয়ার আবদার করেছিলাম সে-বার।
ভিটাকোলা
তখন ১৯৫৭ সাল। আমাদের দেশে প্রথম সফট ড্রিংক হয়ে এলো ভিটাকোলা। বাবা একদিন আমাদের সবার জন্য একটি লাল বরফভর্তি বাক্সে ভিটাকোলা নিয়ে আসলেন। ভিটাকোলা ছিল ব্র্যান্ডের নাম। কোক, ফান্টা, স্প্রাইটের মত কালো, কমলা, সাদা পানীয় ছিল। আমরা যে যার পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতাম। এই হচ্ছে ১৯৫৭ সালে প্রথম ভিটাকোলার আগমনের গল্প। তার আগে কিন্তু ঢাকা শহরে এরকম বোতলজাত কোনো পানীয় ছিল না।
ভিটাকোলার পর কোনটা আসলো তা মনে পড়ে না। একবার যখন কলকাতা গেলাম, '৬০ এর দশকে, তখন বিশ পয়সা দিয়ে এক বোতল কোকাকোলা পাওয়া যেত। তখন খুব আশ্চর্য হতাম যে, ভিটাকোলার বাইরেও এরকম আছে! কারণ পয়সা দিয়ে এরকম পানীয় তখন ছিল না বললেই চলে।
পাংখা বরফের তৃষ্ণা আজও মেটেনি
এখনকার দিনেও আইসক্রিম মানুষ খায়। কিন্তু তখন দু'রকম আইসক্রিম পাওয়া যেত। একটা ছিল বেবি আইসক্রিম, চকচকে ফয়েল কাগজে মোড়ানো। দাম ছিল দু'আনা। আরেকটা ছিল একেবারেই আইস ললি, পাংখা বরফের মতো। এটা ছিল এক আনা। আমার মা পয়সা দিয়ে বলতো, আইসক্রিম খাবে দুই আনার। এক আনারটা খেলে পেট খারাপ হবে।
বাইরের খাওয়া বলতে তখন এটুকুই ছিল।
তাহলে আগে মানুষ তৃষ্ণা মেটাতো কীভাবে? তখন মানুষ শরবত খেতো, পাংখা বরফ খেতো। এই পাংখা বরফ এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা খাওয়ার শখ আমার আজও মেটেনি।
হাঁড়ির মধ্যে বড় বড় চাঁইয়ের বরফ নিয়ে ঘুরত ফেরিওয়ালারা। হাঁড়িগুলো বহন করা কিন্তু বেশ কষ্টদায়ক ছিল। এলাকায় এসে জোরে হাঁক দিতো, 'পা-ং-খা-ব-র-ফ, পা-ং-খা-ব-র-ফ।' ছোট ছোট টুকরো করে বরফগুলোকে হাতে চাপ দিয়ে একেবারে গুঁড়ো করে ফেলত। এরপর তাতে মেশাতো চিনির সিরা, কখনো থাকতো কাঠি। আমার মনে আছে, লাল রঙের সিরাটা বাচ্চাদের সবচেয়ে পছন্দ ছিল।
গুঁড়ো করার সময় ফেরিওয়ালাদের হাতের কারিকুরি অনেকটা হাতপাখার মতো ছিল। তাই বুঝি নাম- পাংখা বরফ।
বাইরের খাবারদাবারের বিষয়ে মা খুব কড়া ছিলেন, যে কারণে এই পাংখা বরফ আর খাওয়া হয়নি। আর এখন তো পাওয়াই যায় না। এই আফসোস আমার সারাজীবন থাকবে।
এরপর ৬২'র দিকে মানুষের হাতে নগদ পয়সা আসা শুরু করলো, তখন আস্তে আস্তে এই বাইরে খাওয়ার রেওয়াজ শুরু হলো।
কিন্তু আমার পরিষ্কার মনে আছে, টিকাটুলিতে এতোবছর ছিলাম, কোনোদিন বাইরে গিয়ে খাইনি। তখন আসলে পরিবার নিয়ে বাইরের খাওয়ার কোনো দোকান বা রেস্টুরেন্ট ছিল না। এমনকি বিয়ে-বৌভাতের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোও বাড়িতে হতো। যা-হোক, বাইরে খাওয়ার যে স্মৃতি আমার মনে পড়ে তা হলো, ঢাকার প্রথম চীনা রেস্টুরেন্ট, 'চু চিং চাও'।
এখনকার সময়ে বাইরে খাওয়ার যে রীতি, সেটা আমদের সময় ছিল না। বরং বাইরে খাওয়াটাকে মানুষ বাঁকা চোখেই দেখতো। বাড়িতে খাওয়ার বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল তখন। রেস্টুরেন্ট বলতে ছিল, চা খাওয়ার দোকানগুলো। আর ছিল পাংখা বরফ, ভিটাকোলা, বেবি আইসক্রিম এসব। অথচ, আমার নানার ছিল শিলংয়ে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। নাম ছিল, 'নিউ চায়না রেস্টুরেন্ট'। কিন্তু আমরা কোনোদিন সেই রেস্টুরেন্টে যাইনি। শুধু একবার আমার নানা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলেন, এতটুকুই।
এখন যে ফুড হোম ডেলিভারি কিংবা বাইরে থেকে এনে বা অর্ডার করে খাওয়ার একটা সংস্কৃতি, সেটাও ছিল না আমাদের যুগে। ঘরের ভিতরে বাইরের খাবার প্রবেশের তেমন রেওয়াজই ছিল না। বাড়িতেই রান্না করা হতো সবসময়। এই হলো ঘরে-বাইরের পার্থক্য। এখন তো সময় পাল্টেছে, রুচি পাল্টেছে, তাই সবকিছুর মধ্যে একটা পরিবর্তনও এসেছে। শেষ প্রান্তে এসে সংস্কৃতি, রুচি, রীতির এরকম বিবর্তন দেখতে বেশ ভালোই লাগে, মনে হয় একজীবনে কত কী দেখছি...!
- আফসান চৌধুরী: গবেষক ও সাংবাদিক