রাশিয়ার বিশাল বিমান বাহিনী গেল কই?- হতবাক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই আধুনিক রণক্ষেত্রের নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে বিমান বাহিনী। যে দেশের বিমানশক্তি যত অত্যাধুনিক ও সুপ্রশিক্ষিত যুদ্ধে তাদেরই জয় হয়। যেমনটা দেখা গেছে, ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ইরাকি স্থলবাহিনীকে পর্যদুস্ত করেছিল আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর বিমান আক্রমণ। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সাদ্দাম হোসেনের সযত্নে গড়ে তোলা ইরাকের বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা, রাডার ঘাঁটি, বাঙ্কার, অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের আগেও মার্কিন গোয়েন্দারা অনুমান করেছিলেন, প্রবল পরাক্রমে দেশটিতে হামলা চালাবে রাশিয়া। মোতায়েন করবে নিজেদের বিশাল যুদ্ধবিমান শক্তির পুরোটাই, এভাবে ইউক্রেনের আকাশে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করবে।
কিন্তু গত ছয় দিনের ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের এসব অনুমানের প্রতিফলন দেখা যায়নি। মস্কো উল্টো অনেক সতর্কতার সাথেই ব্যবহার করছে তাদের বিমানশক্তি। এতটাই সাবধানে তারা বিমান হামলা করছে যে, এখন মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন—ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতেই আক্রমণের এমন নীতি নিয়েছে রাশিয়া।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সকেও এমন কথা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি মন্তব্য করেন, "তারা (রাশিয়া) নিজেদের বিমান ও পাইলট হারানোর উচ্চ ঝুঁকি নিতে চাইছে না।"
এদিকে রাশিয়ার তুলনায় সংখ্যার বিচারে ইউক্রেনের বিমান বাহিনী নগণ্য হলেও এখনও তারা যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে মিশন পরিচালনা করছে। এমনকি অক্ষত রয়েছে তাদের নিজস্ব আকাশপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কিছু অংশ- এ ঘটনাও সমর বিশেষজ্ঞদের হতবাক করেছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর সময়ে এসব বিশেষজ্ঞ অনুমান করেছিলেন, রাশিয়া তাৎক্ষনিকভাবে ইউক্রেনের বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধবংস করে দেবে।
এব্যাপারে লন্ডন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (রুসি)- 'রাশিয়ান বিমান বাহিনীর রহস্যময় অন্তর্ধান' শীর্ষক এক নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। সেখানে সংস্থাটির বিশ্লেষকরা লিখেছেন, "বিমানশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারই ছিল (বিশেষজ্ঞ মহলে) কাম্য এবং সেটাই হতো যুক্তিপূর্ণ। কারণ ১৯৩৮ সালের পর প্রায় প্রতিটি যুদ্ধই এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে।"
রাশিয়ার পক্ষে এখনও তেমনটা চোখে পড়ছে না। বরং ইউক্রেনীয় ফাইটার জেটগুলোকে খুব নিচু দিয়ে উড়ে গিয়ে শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে দেখা যাচ্ছে। এ কৌশলে তারা নিজেদের স্থলবাহিনীকে প্রতিরোধ যুদ্ধে সহায়তা দিচ্ছে। আর রাশিয়ার বিমানগুলিকে এখনও শত্রুর দ্বারা চ্যালেঞ্জপূর্ণ আকাশসীমায় উড়তে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার রাশিয়ান বিমানের জন্য হুমকি হয়েই রয়েছে। এই হুমকির কারণে রুশ পাইলটরা তাদের অগ্রসরমান স্থলবাহিনীকে খুব একটা সাহায্য করতে পারছে না।
তবে কম বিমানশক্তি ব্যবহারের বিষয়টি এত সহজ নয়, বলে ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রুশ সামরিক বাহিনী বিশেষজ্ঞ রব লী। তিনি বলেন, "তাদের কাজকর্মে হতবাক হতে হচ্ছে।"
যুদ্ধের শুরুতেই তিনি অনুমান করেন, রাশিয়া তার সমস্ত বিমানশক্তি ব্যবহার করবে।
রব লী এখন বলছেন, "সময়ক্ষেপণের কারণটাই ধরতে পারছি না। এমন যুদ্ধে যত দিন যায়- প্রতিপক্ষের হাতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। একইসাথে, বেড়ে যায় শত্রুর শক্তিশালী হয়ে ওঠার ঝুঁকি। তাই রাশিয়া যে বিমানশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার এখনও কেন করছে না- তা কোনো বাস্তবিক কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি না।"
এদিকে রাশিয়ার বিমানশক্তি ব্যবহার নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এমন সময়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন যখন কিয়েভের তরফ থেকে 'নো ফ্লাই জোন' বা উড্ডয়ন নিষিদ্ধ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ডাক বাতিল করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, এ অনুরোধ রক্ষা করা হলে- তা হতো রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধেরই নামান্তর।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার স্থলবাহিনীর সাথে বিমান বাহিনীর সমন্বয়ের অভাবও লক্ষ করছেন। এমনকি নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরেও পাঠানো হয়েছে রুশ সেনাদের অনেকগুলো কলাম।
এতে করে রাশিয়ান সেনাদের ওপর ইউক্রেনের হামলা বহুগুণে বেড়েছে। ইউক্রেন তুরস্ক থেকে কেনা বাইরাক্তার টিবি-২ এর মতো ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে রুশ সাঁজোয়া বহরের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে তৈরি ট্যাংক বিধংসী অস্ত্রগুলো দিয়েও হামলা চালাচ্ছে তারা।
রুশ সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে আকাশপথে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অভাবে। এমনটাই মনে করেন, মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক তিন তারকা জেনারেল ডেভিড ডেপটুলা। এর আগে তিনি উত্তর ইরাকে 'নো ফ্লাই জোন' প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তিনি যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়া আকাশপথ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও প্রাণান্ত চেষ্টা না করায় বিস্মিত হয়েছেন বলে জানান।
তিনি রয়টার্সকে বলেন, "মাল্টি-ডোমেইনে (স্থল, নৌ ও আকাশে) সমর অভিযান পরিচালনা সমন্বয় করা সহজ কথা নয়। রাশিয়ানরা এখন তা বেশ বুঝতে পারছে। এনিয়ে তারা যতোটা দক্ষ ধারণা করা হয়েছিল, হয়তো ততোটা নয়।"
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, এপর্যন্ত রাশিয়ান বাহিনীর প্রত্যাশার চেয়ে নিম্ন মানের রণ-পারদর্শিতা দেখিয়েছে। সে তুলনায় ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর প্রতিরোধ সব ধারণাকে ছাপিয়ে গেছে।
ইউক্রেন এ ধরনের সর্বাত্মক যুদ্ধে কুশলী সাফল্য পাবে, তাও রাশিয়ার বিরুদ্ধে—কেউই তা আশা করেননি। এমন যুদ্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই তাদের। কারণ গত দুই দশকে ডনবাস এলাকায় রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীদের সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আদলে খন্দক/ পরিখায় (ট্রেঞ্চ) যুদ্ধ করেছে দেশটি। যে যুদ্ধের সম্মুখভাগ ছিল স্থিতিশীল। উভয়পক্ষই তাদের নিয়ন্ত্রিত সীমা বরাবর গোলাগুলি বিনিময় করেছে।
সে তুলনায় সিরিয়ায় যুদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে রাশিয়ান বাহিনী। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়ে স্থল ও বিমান বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের সক্ষমতাও প্রদর্শন করে।
এরপরও ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর জঙ্গিবিমানের নিয়মিত উড্ডয়ন প্রমাণ করছে, সর্বাত্মক হামলায় তাদের নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়নি। বরং তারা আঘাত সামলাতে অনেক বেশি অদম্যতার পরিচয় দিয়েছে। এতে দেশটির জনগণ ও সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের মনোবলও চাঙ্গা হয়েছে।
তবে এনিয়ে কিছু গুজবও ছড়াচ্ছে। যেমন, তথাকথিত 'গোস্ট অব কিয়েভ' নামে একজন ইউক্রেনীয় পাইলটের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি করা হচ্ছে, তিনি নাকি একাই ছয়টি রুশ যুদ্ধবিমান ধবংস করেছেন। তবে এসব ভিডিও বানোয়াট এবং মিথ্যা বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের ফ্যাক্টচেক (তথ্যের নির্ভুলতা যাচাইকরণ)- এ দেখা গেছে, ডিজিটাল কমব্যাট সিম্যুলেটর নামক একটি ভিডিও গেমের আকাশযুদ্ধের ফুটেজকে 'গোস্ট অব কিয়েভ'- এর কীর্তি বলে প্রচার করা হচ্ছে।
এদিকে গত মঙ্গলবার (১ মার্চ) আমেরিকান নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বার্ষিক ভাষণ (স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন) দানকালে জো বাইডেন উঠে দাঁড়িয়ে লড়াইরত ইউক্রেনীয় জনতার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তিনি তাদের প্রতিরোধের প্রশংসার পাশাপাশি পুতিনকে ব্যঙ্গ করে বলেন, "তিনি ভেবেছিলেন ইউক্রেনে ঢুকে পড়লেই বিনা-যুদ্ধে বিজয়ী হবেন, কিন্তু তা হবার নয়। তার বাহিনীকে শক্তিশালী প্রতিরোধের দেয়াল রুখে দিয়েছে। এবার তাকে ইউক্রেনের জনতার মোকাবিলা করতে হবে।"
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমান, অভিযানে মাত্র ৭৫টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে রাশিয়া।
তবে আগ্রাসনের আগে মার্কিন কর্মকর্তারা গোয়েন্দা সূত্রের ভিত্তিতে অনুমান করেন, আগ্রাসন চালাতে নিজ বাহিনীর হাজারো বিমানের মধ্যে অন্তত কয়েকশ' মোতায়েন করবে রাশিয়া।
মঙ্গলবার জ্যেষ্ঠ একজন মার্কিন কর্মকর্তা অবশ্য রাশিয়া ঠিক কতগুলি জঙ্গিবিমান ও কমব্যাট হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে বা কতগুলো হামলার জন্য ইউক্রেনের সীমান্তে প্রস্তুত রয়েছে— সে সংখ্যা অনুমানের ভিত্তিতে জানাতে অস্বীকার করেন।
কিন্তু, তিনি বলেছেন উভয়পক্ষেই প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
"আমরা জেনেছি তাদের (রাশিয়ার) কিছু যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। ইউক্রেনেরও হয়েছে। প্রতিদিন ইউক্রেনের আকাশ দখলের লড়াই চলছে।"
- সূত্র: আল জাজিরা