‘হারুন ডাইরি’ আর ফুটো পয়সা
গতসংখ্যায় পাংখা বরফের কথা উল্লেখ করার পর মানুষের কাছ থেকে এত সাড়া পেয়েছি যে, এবার আরও কিছু হারিয়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি।
একজন বলেছে, ছোট থেকে বড় হবার যাত্রায়, পাংখা বরফ ছিল একটি বিরাট বিষয়। একজন পাকিস্তান থেকে লিখেছে, ছোটোবেলায় পাংখা বরফের জন্য যে কী করেছিলাম, তা চিন্তা করা যায় না। অন্য একজন লিখেছেন, আমার মা এই পাংখা বরফের গল্প এখনও করে। সুতরাং আমাদের ছোটবেলার সঙ্গে পাংখা বরফে সম্পর্ক বেশ গভীর।
'মালাই আইসক্রিম' আর 'কুলফি বরফ'
একধরনের 'আইসক্রিম' ছিল, নাম দুধ মালাই আইসক্রিম। দুধ-ক্ষীর আর পেস্তাবাদাম মিশিয়ে একটা খোপের মধ্যে পুরে বরফের নিচে রেখে দেওয়া হতো। জমে গেলে তা বের করে এনে বিক্রি করতো।
আর কুলফি ছিল একটু উপরতলার খাবার। কুলফিকে ডাকতাম আমরা কুলফি বরফ বলে। পাঙ্খা বরফের মতো হাঁড়িতে কুলফি নিয়ে ফেরিওয়ালা ঘুরতো।
তবে দাম ছিল একটু বেশি। তাই রাস্তায় বিক্রির চেয়ে দোকানগুলোতে পাওয়া যেত বেশি। দুধ,বাদাম এবং সুঘ্রানের নানা উপাদান থাকায়, কুলফি বরফের মধ্যে একটা বেশ শাহী ভাব ছিল।
এখন তো কুলফি দশ টাকাতেও বিক্রি হয়। কিন্তু তখন একজন মানুষ মাসে একবার কুলফি বরফ খেত কি-না বলা যায় না। হয়তো কয়েকমাসে একবার খেত। একসময় পুরান ঢাকার বনেদি খাবার ছিল এই কুলফি বরফ।
হারুন ডাইরি
আমি ১৯৫৭ সালে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তখন দেখতাম, 'বেবি আইসক্রিম' কোম্পানির ঠেলা গাড়িতে নিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতো।
বাক্সের মধ্যে দু'রকম আইসক্রিম পাওয়া যেতো। এক আনা দামে পাওয়া যেত, খোলা বরফ ভেতরে কাঠি দেওয়া একধরনের আইসক্রিম। দামে কম বলে সবাই এটা বেশি খেত।
আরেকটা ছিল, চকচকে রঙে মোড়া নরম দুধেল বাটি আইসক্রিম, দাম দুই আনা। আমরা খেলে ওটা-ই খেতাম।
এই বেবি আইসক্রিম কোম্পানির মালিক ছিলেন নায়ক হারুন। তখন 'হারুন ডাইরি' খুব নামকরা ছিল। দৈনিক বাংলার উল্টোদিকে নায়ক হারুনের হারুন ডাইরি নামে স্টেশনারির দোকানও ছিল।
ফুটো পয়সা
ফুটো পয়সার মাঝেখানে আসলেই একটা ফুটো থাকতো। এটি ছিল সবচেয়ে নিম্নমূল্যের। কারণ এতে তামার পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম।
অর্থের মূল্য না থাকলেও রক্ষাকবচ হিসেবে এর ব্যবহার ছিল ঠিকই। কালো কাইতনের ফিতা বেঁধে একটা-দুটো ফুটো পয়সা দিয়ে সুতোর ভিতরে গেঁথে দিয়ে বাচ্চার কোমরে বেঁধে দেওয়া হতো। কুদৃষ্টি থেকে সন্তানকে রক্ষার যে চিরাচরিত ধারণা, সেখান থেকেই মায়েরা তাদের বাচ্চাদের কোমরে এই ফুটো পয়সা বেঁধে রাখতো।
পাংখা বরফ খেতে হলে, একটা ফুটো পয়সা হলেই চলতো। কিন্তু কুলফির দাম ছিল চার আনা। যেটাকে আমরা বলতাম সিকি। পঞ্চাশের দশকের সিকি ছিল বড় অঙ্কের পয়সা।
টিকাটুলির স্পোর্টিং ক্লাব
সেসময় টিকাটুলিতে তরুণদের জন্য একটা ক্লাব ছিল। অনেক মানুষের আসা যাওয়া ছিল এই ক্লাবে। মূলত একটা বিনোদনের, আড্ডাস্থল ছিল এই স্পোর্টিং ক্লাব।
ছোটলু মামা (আলী যাকের), বুলবুল আহমেদ, রবি মামা, শামীম মামা (শাহেদ কামাল), ফতেহ আলী চৌধুরী এবং শাহাদাত চৌধুরীর বড় ভাইসহ ( নামটা ঠিক মনে নেই) আরও অনেকে আসতেন এই ক্লাবে। তবে, এরা যে খুব বড় খেলোয়াড় ছিলেন তা নয়, কিন্তু এরা সবাই বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন পরবর্তীতে। স্পোর্টিং ক্লাব হলেও, বেশিরভাগই আসতেন আড্ডা দিতে। অনেকেই বেঁচে আছেন এখনও, অনেকে মারাও গেছেন।
সেই টিকাটুলি স্পোর্টিং ক্লাবে একজন সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৫৬-৫৭ সালের সেই সেক্রেটারির সাহেবের নামটা আমার মনে নেই, কিন্তু এটুকু মনে আছে, তিনি বেশ অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, থাকতেন বিশাল এক বাড়িতে।
তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ বছর। তিনি ছিলেন আমার বাবার বয়সী, অবিবাহিত। ওনার বাড়িতে সবার অনেক যাতায়াত ছিল। কিন্তু আমি নিতান্তই ছোট ছিলাম বলে, যাওয়ার সুযোগ হয়নি তেমন।
কিন্তু একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল সে বাড়িতে। বাসাটা কোথায় ছিল, তা খেয়াল নেই। কিন্তু গিয়ে দেখতে পেলাম অদ্ভুত এক যন্ত্র। কাঠের একটা বড় ঢাকনালাগানো বালতি। আর তার হাতল ধরে ঘোরাচ্ছে একজন ব্যক্তি। ভিতরে বরফ আর লবণ শুধু।
কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল দেখছিলাম। একপর্যায়ে দেখলাম, বালতির গায়ের এক ফুটো দিয়ে দুধ আর পানির মতো কী যেন বের হচ্ছে। যখন সব বের হয়ে গেল, তখন একজন বলে উঠলেন, 'হ্যাঁ হয়ে গেছে'।
এরপর সেখান থেকে লবণ আর বরফ সরিয়ে একটা বড় বাটি বের করলো, বাটির ভিতরে আইসক্রিম। এভাবেই তখন আইসক্রিম বানানো হতো।
আইসক্রিম তৈরির এই পদ্ধতি এখন আর নেই। যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন বাসায় আইসক্রিম বানাতে চাইলে এই পদ্ধতিতেই বানানো হতো। কিন্তু এটা কেবল অবস্থাসম্পন্ন বাড়িগুলোতেই হতো। আমাদের বাড়িতেও পরে এভাবে আইসক্রিম বানানো হয়েছে।
জীবনে এরকম আইসক্রিম আমি সেবার-ই প্রথম খেয়েছি। একদম নরম, সুন্দর আর সাদা ধবধবে আইসক্রিম। মজার কথা হলো, আমাকে যখন সেক্রেটারি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কয়টা খাবে? আমি বললাম, 'সব খাবো' । আমার এই উত্তরে সেক্রেটারি সাহেব সেদিন হো-হো করে হেসে উঠেছিল!
- লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক