পুরান ঢাকার স্ট্রিটফুড: ৩০ টাকার মধ্যে মুখরোচক সব খাবার!
পশ্চিমাদের 'ফাস্ট ফুড' ধারণার প্রভাবে বাংলাদেশেও এখন পথেঘাটে ক্যাফে আর রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি। এসব রেস্টুরেন্টের অধিকাংশতেই খাবারের দাম বেশি। তবে ব্যতিক্রমী পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার রাস্তা বা রাস্তার পাশের ছোট্ট টং দোকানে এখনও স্বল্পদামে বিক্রি হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী বহু মুখরোচক খাবার।
সুলতানি, মোগল, নবাবী, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের ৪০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস থেকে পুরান ঢাকার মেন্যুতে যোগ হয়েছে এসব খাবার। কাবাব, বিরিয়ানির পাশাপাশি রাস্তায় বিক্রি হওয়া এই খাবারগুলোও সমানভাবে জনপ্রিয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে হাজার হাজার মানুষ এসব খাবার খেতে পুরান ঢাকার রাস্তায় ভিড় জমায়। এই খাবারগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো খুব কম দামে পাওয়া যায়। তবে স্বাদে ও মানে যেকোনো নামীদামী হোটেলকেও তা হার মানাবে।
পুরান ঢাকার রাস্তায় বিক্রি হওয়া এমন সব ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় কিছু খাবার নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
বাকরখানি
পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে সবচেয়ে বেশি যে খাবারটি পাওয়া যায় তা হলো বাকরখানি। এটি পুরান ঢাকাবাসীদের একটি জনপ্রিয় খাবার। সকাল বিকাল নাস্তার সাথে বাকরখানি না হলে যেন তাদের চলেই না। শুধু পুরান ঢাকা নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাসহ কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এটি রপ্তানি করা হচ্ছে।
বাকরখানির প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। খেতে সুস্বাদু, মচমচে ও নরম এই খাবারটি পুরান ঢাকাবাসী ডালভাতের মতোই খেয়ে থাকে। পুরান ঢাকায় গেলে একবারের জন্য হলেও এই খাবারটি না খেয়ে ভুল করবেন না।
পুরান ঢাকায় কয়েক প্রকারের বাকরখানি পাওয়া যায়। কোনোটি নোনতা, কোনোটি মিষ্টি আবার কোনোটা পনিরের বাকরখানি। কোনো বাকরখানিতে মাংস ও ঝাল ব্যবহার করা হয়। সবগুলোরই রয়েছে ভিন্ন স্বাদ।
পুরান ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে এই খাবারটি পেয়ে যাবেন। মূলত কেজি হিসেবে বাকরখানি বিক্রি করা হয়। ১৩০-২০০ টাকার মাঝে বিভিন্ন প্রকারের বাকরখানি পেয়ে যাবেন। কেউ চাইলে পিস হিসেবেও এটি খেতে পারবে। প্রতি পিস বাকরখানির দাম পাঁচ টাকা থেকে শুরু।
পনিরের সমুচা
খাদ্য হিসেবে পনির একটি উপাদেয় খাবার। হাড় শক্তকরণ, দাঁতের মজবুতকরণ, ক্যান্সার প্রতিরোধী, ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ পনিরের রয়েছে বহুবিধ উপকার। পুরান ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় বাঁশের ঝুড়িতে পনির বিক্রি করার চিত্রটি আপনি একটু পরপর দেখে থাকবেন। এটি মূলত ঢাকাই পনির। পুরান ঢাকার যে সব খাবারে এই পনির ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পনিরের সমুচা।
রোজার মাঝে এই সমুচার চাহিদা অনেক বেড়ে গেলেও সারাবছর পুরান ঢাকার চকবাজার, লালবাগের রাস্তার পাশের ছোট দোকানগুলোসহ বিভিন্ন জায়গায় এই খাবারটি বিক্রি করা হয়। ময়দা ও মাখানের ডোতে পনির ছাড়াও এই সমুচায় ব্যবহার করা হয় পেঁয়াজের কুচি, কাঁচা মরিচের কুচি, মরিচের গুঁড়া ও লবণ। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে পনির। সমুচায় কামড় দিয়ে একটু অংশ আলাদা করলেই দেখা যাবে পনির গড়িয়ে বের হয়ে আসছে।
পুষ্টিগুণে ভরপুর ও খেতে সুস্বাদু পনিরের সমুচা পুরান ঢাকায় পেয়ে যাবেন ১০-১৫ টাকায়।
মুড়ি ভর্তা
ঝাল মুড়ির স্বাদ আমরা হরহামেশা নিয়ে থাকলেও মুড়ি ভর্তার স্বাদ নিয়েছেন কজন? বিশেষ শাহী মসলায় তৈরি এই খাবারটি শুধু পুরান ঢাকাতেই পাওয়া যায়। খাওয়ার পর এই মসলার স্বাদ আপনার জিভে অনেকক্ষণ লেগে থাকবে। পুরান ঢাকার লালবাগ, জিঞ্জিরা, নাজিরাবাজার, চকবাজারসহ বিভিন্ন অলিগলিতে দেখা মিলবে শাহী মসলার এই মুড়ি ভর্তার। দাম পড়বে ১০-২০ টাকা।
চিকেন ব্রেড
লালবাগের শাহী জামে মসজিদের পাশেই এই খাবারটি পেয়ে যাবেন। মুরগির মাংস ও পাউরুটির মিশ্রণে তৈরি এই খাবারটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। একবার মুখে দিলে বার বার এর স্বাদ আপনাকে কাছে টানবে।
এই খাবারটি তৈরি করার জন্য প্রথমে মুরগির মাংস পিষা হয়। মাংসের কিমার সঙ্গে গাজরের মিশ্রণ তৈরি করা হয়। পাউরুটির ভেতর এই মিশ্রণ দিয়ে ভালোমতো মুখ বন্ধ করে সবশেষে গরম কড়াইয়ে ভেজিটেবল অয়েল দিয়ে ভাজা হয়। কড়াই খুব গরম না হলে এর ভালো স্বাদ পাওয়া যায় না।
প্রতি পিস চিকেন ব্রেডের মূল্য ২০ টাকা।
অনথন
পুরান ঢাকার আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো অনথন। অত্যন্ত সুস্বাদু এই খাবারটি হালিম, স্যুপ বা শুধু সস বা টকের সাথে খাওয়া হয়।
হাড় ছাড়া মুরগির মাংস, চিংড়ি গুড়া, ডিম, কর্ণ ফ্লাওয়ার, গাজর, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ, আদার মিশ্রণকে ময়দার ডো থেকে তৈরি রুটির ভেতর গুঁজে দিয়ে বিশেষ আকৃতিতে অনথন তৈরি করা হয়। সবশেষে গরম তেলে ভেজে এটি পরিবেশন করা হয়।
পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার, চক বাজার, মৌলভী বাজার, বেগম বাজার, লালবাগের রাস্তার পাশে ফাস্টফুডের ছোট ছোট দোকানগুলোতে অনথন পেয়ে যাবেন। দাম ৮ থেকে ১৫ টাকা।
ছোলা বুটের কালো ভুনা
যারা খুব ঝাল পছন্দ করেন তাদের জন্য পুরান ঢাকার রাস্তায় বিক্রি হওয়া এই ছোলা বুটের কালো ভুনা একটি আদর্শ খাবার। নিজস্ব তৈরি মসলা দিয়ে প্রথমে ছোলাকে ভুনা করা হয়। এরপর এর সাথে আধভাঙা শুকনো মরিচ, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা কুচি, টমেটো কুচি, শসা কুচি, পেঁয়াজ কুচি মেশানো হয়। এর উপর তেতুলের টক দিয়ে পরিবেশন করা হয়। খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও ঝাল এই খাবারটি চকবাজার মোড় ও লক্ষীবাজার মোড়ে বিকাল ৪ টার পর থেকে পেয়ে যাবেন। প্রতি ঠোঙা মাত্র ১০ টাকা।
কলিজা সিঙ্গারা
বিকালবেলার নাস্তা হিসেবে সিঙারা বা সমুচা খেতে আমরা সকলেই ভালোবাসি। আর তা যদি হয় কলিজার সিঙ্গারা তাহলে তো আর কথাই নেই। খাওয়ার স্বাদকে তা হাজারগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডের বাগান গলির মোড়ে ফুড সিটিতে মজাদার এই সিঙ্গারা পেয়ে যাবেন। সাধারণত সিঙ্গারার আকৃতি ছোট বা মাঝারি আকারের হয়। কিন্তু এখানকার কলিজা সিঙ্গারা আকৃতিতে খানিকটা বড়। দু-একটা খেয়েই সম্ভবত পেট ভরে যাবে। ভেতরে মুরগির কলিজা ও আলুর সমন্বয়ে তৈরি এই সিঙ্গারা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। দাম প্রতি পিস ২০ টাকা।
চিকেন ললি ও চিকেন টিকা
চিকেন থেকে তৈরি মুখরোচক খাবারগুলোর প্রতি সবারই কমবেশি আগ্রহ আছে। পুরান ঢাকার চকবাজার, নাজিরা বাজার, বেগমবাজার, আলুবাজার এলাকায় রাস্তার পাশের দোকানে এই মজাদার খাবারগুলো পেয়ে যাবেন। অন্যান্য জায়গার চিকেন ললিতে কাঠি ব্যবহার করলেও পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে সাধারণত মুরগির পাখনাকেই কাঠির আকৃতি দেওয়া হয়। মুরগির পাখনার সাথে কাবাবের মসলা, বিশেষ প্রক্রিয়ার টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। কাবাবের মসলা এতে আকর্ষণীয় একটি স্বাদ যোগ করে এবং টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়া থেকে তৈরি হয় মচমচে ভাব। যারা ভাজাপোড়া পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি একটি লোভনীয় খাবার। প্রতি পিস চিকেন ললি পেয়ে যাবেন মাত্র ৩০ টাকায়।
পুরান ঢাকার রাস্তার আরেকটি মজাদার খাবার হলো চিকেন টিকা। এখানকার চিকেন টিকাগুলোতে বিক্রেতারা নিজেদের তৈরি বিশেষ মসলা ব্যবহার করেন। স্বাদে অনন্য এই চিকেন টিকাগুলো ঢাকার যেকোনো জায়গার চেয়ে পুরান ঢাকায় কম দামে বিক্রি করা হয়। এখানে প্রতি পিস মাত্র ১০ টাকায় চিকেন টিকা পেয়ে যাবেন।
১০ টাকায় চার সমুচা-সিঙ্গারা
পুরান ঢাকার রাস্তার আরেকটি জনপ্রিয় খাবার হলো এই ১০ টাকার চারটি সমুচা-সিঙ্গারা। খুব ছোট আকারের হলেও মচমচে ভাঁজার কারণে খেতে অত্যন্ত মজাদার ও সুস্বাদু এই ১০ টাকার সমুচা-সিঙ্গারা। ছোট্ট কাঁচের গাড়িগুলোতে ঠেলতে ঠেলতে এগুলো বিক্রি করা। এখানকার অলিগলিতে হাঁটার সময় একটু পর পর সমুচা-সিঙ্গারার এই কাঁচের গাড়িগুলো আপনি দেখতে পাবেন। প্রায় শ' খানেকের মতো এমন কাঁচের গাড়ি পুরান ঢাকার চকবাজার, বউবাজার, লালবাগ, সিদ্দিক বাজার, বাংলা বাজার, বংশালের রোডগুলোতে প্রায় অহরহ দেখতে পাওয়া যায়।
২ টাকার আলুর দম
বলা হয় আপনার পকেটে নামমাত্র টাকা থাকলেও পুরান ঢাকায় খাবারের অভাব হবে না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে দুই টাকা দিয়ে বর্তমান সময়ে এসেও ঢাকায় খাবার পাওয়া যায়। লালবাগের ওয়াটার ওয়াকর্স রোডে মাত্র দুই টাকায় পেয়ে যাবেন জম্মু ও কাশ্মিরের জনপ্রিয় খাবার আলুর দম। দুই টাকার হলেও খাদ্যগুণে ভরপুর এই খাবারটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু।