যেভাবে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের ‘আগুনে ঘি ঢেলেছে’ পশ্চিমা দেশগুলো
ইউক্রেনে হামলা চালানোয় রাশিয়ার সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবে সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে পড়েছে পশ্চিমা নেতাদের নীতি এবং কর্মকাণ্ডও।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এ সংঘাতের পক্ষপাতপূর্ণ সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগ তুলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমের বাইরের বিশ্লেষকরা। পশ্চিমা নেতাদের বিরুদ্ধে দ্বৈত নীতি গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন তারা। পশ্চিমা নেতারা রাশিয়াকে খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করার সব রকমের চেষ্টাই করে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন তারা।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রচারিত 'বর্ণবাদী' সংবাদের নিন্দা জানিয়ে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিকদের সংগঠন এএমইজিএ।
পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিচারিতা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এতে রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে ভুগবে।
বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় কিছু 'সুবিধাভোগী'র বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন বাইডেন। এই সুবিধাভোগীরা হলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পুঁজিবাদী বন্ধুরা। বাইডেনের ভাষ্যে, এই বন্ধুরা ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনকে সমর্থন দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন ও ইইউও রাশিয়ার ওপর 'কঠোর' নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ইতিমধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রাশিয়ার অভ্যন্তরে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, রাশিয়ানরা লাইনে দাঁড়িয়ে এটিএম ও ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে নিচ্ছে।
তবে মজার ব্যাপার হলো, সিংহভাগ পশ্চিমা সাংবাদিকরা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা খবর জোর গলায় প্রচার করলেও, দেশটির গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল রপ্তানির ওপর যে ইউরোপ-আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, সে খবর আর প্রচার করছেন না।
ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইপলাইন গাজপ্রম। এই গাজপ্রম এখনও ইউরোপীয় গ্রাহকদের অর্ডারের ভিত্তিতে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করছে।
ইউক্রেন ২০১৪ সালে রাশিয়া থেকে সরাসরি গ্যাস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু একই পাইপলাইন দিয়ে ইউরোপের মাধ্যমে গ্যাস নিচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও এভাবেই গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক রাশিয়া, একইসাথে সর্ববৃহৎ গ্যাস রপ্তানিকারকও।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে যদি রাশিয়ার গ্যাস যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শীতকালে ইউরোপের ঘরবাড়ি গরম রাখার উপায় থাকবে না। তাতে ঠান্ডায় জমেই মারা যাবে বহু মানুষ। এছাড়া বিমান ও গাড়ি রিফুয়েল করতেও গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
আরেক বৃহৎ রপ্তানিকারক কাতারের চেয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে বেশি সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পায় ইউরোপের দেশগুলো।
নিষেধাজ্ঞা—দোধারী তলোয়ার
জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অচল কুমার মালহোত্রা বিবিসিকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা হলো দোধারী তলোয়ার—দুদিকেই কাটে।
তিনি বলেন, 'নিষেধাজ্ঞা পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন পুতিন। আর এখন পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা খুব একটা কার্যকরী প্রমাণিত হয়নি। আমার ধারণা, ইউক্রেনে হামলা চালানোর আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে পশ্চিমা দেশগুলো তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এবং সে নিষেধাজ্ঞা কীভাবে সামলাতে হবে, তার উপায়ও তিনি ভেবে রেখেছেন। পুতিন অর্থনীতির চেয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি জানেন নিষেধাজ্ঞা হলো দোধারী তলোয়ার। নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
খুব অল্প কয়েকজন পশ্চিমা সাংবাদিকই পশ্চিমা নেতাদের 'দ্বিমুখী' নীতির সমালোচনা করেছেন। সেই গুটিকয়েক সাংবাদিকদের একজন নিউ ইয়র্কভিত্তিক সাংবাদিক জেরেমি সাহিল। পরপর বেশ কয়েকটি টুইটে তিনি বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে যা করছে, তা সবদিক থেকেই অন্যায় এবং কেউই তা সমর্থন করবে না। কিন্তু তার মতে, এ বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ইতিহাসও খুব একটা ভালো নয়।
এক টুইট বার্তায় জেরেমি সাহিল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিজের অপরাধের দায় অস্বীকার করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার হামলার যে নিন্দা করেছে, গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। বিশেষ করে যারা ন্যাটো ও আমেরিকার সামরিক কাজকারবারের ইতিহাস জানেন, তাদের চোখে গ্রহণযোগ্যতা কমেছে বেশি। আর এর সুবিধা পেয়েছেন পুতিন।
আফগানিস্তান, ইরাক দখলের সঙ্গে তুলনা
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগে, একুশ শতকের প্রথম দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করেছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠিয়েছে। সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে লিবিয়া ও সোমালিয়াতেও।
১৯ বছর আগে ওয়েপনস অভ ম্যাস ডেসট্রাকশন (ডব্লিউএমডি) থাকার অভিযোগ তুলে ইরাকে আক্রমণ চালান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। তার অভিযোগ ছিল, ইরাক এই মারণঘাতী অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে এবং প্রতিবেশী ও নিজ জনগণের ওপরও এ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে।
এর সঙ্গে আরেকটা অভিযোগ তুলেছিলেন বুশ। তার দাবি ছিল, ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন আল কায়েদা ও অন্যান্য চরমপন্থিদের আশ্রয় দিয়েছে। এমনকি আমেরিকায় নয়-এগারোর হামলার পেছনে সাদ্দামের হাত ছিল—এমন দাবিও তুলেছিলেন বুশ।
কিন্তু হামলা চালানোর পর অবশেষে দেখা গেল ইরাকে ডব্লিউএমডি কখনোই ছিল না। এরপর আমেরিকা ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম তখন একে 'অনিচ্ছাকৃত ভুল' বলে এই ইস্যু এড়িয়ে যায়।
ইউক্রেন সংকটের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ পুতিন ও রাশিয়ার সমালোচনা করছে। তবে তারা কোরিয়া ও ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য দেশে আমেরিকার হামলা নিয়েও কথা বলছে। আমেরিকার অতীত-যুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
সংবাদমাধ্যমের 'বর্ণবাদ'
বেশ কয়েকটি দেশের সংবাদ সংস্থা পশ্চিমা গণমাধ্যমের সমালোচনা করে অভিযোগ তুলেছে যে ইউক্রেন যুদ্ধের সংবাদ প্রচারে পশ্চিমা সাংবাদিকেরা 'বর্ণবাদী' আচরণ করছেন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ-সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের সময় সিবিএস, টেলিগ্রাফ, আল-জাজিরার মতো খ্যাতনামা সংবাদ সংস্থাগুলো বর্ণবাদী খবর প্রচার করছে জানিয়ে রোববার সংগঠনটি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিক সংগঠন এএমইজিএ।
এএমইজিএর বিবৃতি অনুসারে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সিবিএস নিউজের প্রতিবেদক শার্লি ডি'অগাতা ইউক্রেন সম্পর্কে মন্তব্য করতে এক পর্যায়ে গিয়ে বলেন, 'সম্মানের সঙ্গেই বলছি যে এটা ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো কোনো জায়গা নয়, যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলছে। ইউক্রেন অপেক্ষাকৃত সভ্য, অপেক্ষাকৃত ইউরোপীয় অঞ্চল। আমি বেশ ভেবে-চিন্তেই শব্দগুলো বলছি। এটা এমন অঞ্চল যেখানে এসব বিষয় ঘটতে পারে বলে আপনি আশা করেন না।'
যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের মানুষের ওপর নেমে আসা দুর্ভোগ নিয়ে টেলিগ্রাফে ড্যানিয়েল হানান লিখেছেন, 'তারা [ইউক্রেনিয়ানরা] দেখতে যেন আমাদের মতোই। আর এ জায়গাতেই সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে। যুদ্ধ এখন এমন কোনো বিষয় নয় যা দূরের কোনো দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আঘাত হানবে। যে-কেউ এর কবলে পড়তে পারে।'
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আল-জাজিরা ইংরেজির উপস্থাপক পিটার ডোবি বলেন, 'তাদেরকে দেখতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী বলে মনে হবে না। এরা উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও পালানোর চেষ্টা করছে না। এরা দেখতে আপনার পাশের বাসার যেকোনো ইউরোপীয় পরিবারের মতোই।'
বিএফএম টিভির প্রতিবেদক ফিলিপ করবে বলেন, 'আমরা সিরিয়ার ওপর পুতিনের হামলায় পালাতে থাকা সিরিয়ানদের কথা বলছি না। আমরা ইউরোপীয়দের কথা বলছি যারা দেখতে আমাদের মতোই। প্রাণ বাঁচাতে তারা গাড়িতে করে দেশ ছাড়ছে।'
বর্ণবাদী ও ইউরোপকেন্দ্রিকক প্রতিবেদনের জন্য বিবিসিও সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিবিসিতে ইউক্রেনের ডেপুটি চিফ প্রসিকিউটর ডেভিড স্যাকভেয়ারলিজের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সেখানে তিনি বলেন: 'এটা আমাদের জন্য খুব আবেগের বিষয়। কারণ আমি প্রতিদিন পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র, হেলিকপ্টার ও রকেটের আঘাতে সোনালি চুল আর নীল চোখের ইউরোপীয় মানুষদের মারা যেতে দেখছি।'
পশ্চিমা সাংবাদিকদের এসব মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অনেকেই। এসব মন্তব্য নিয়ে তৈরি হয়েছে ভিডিও ক্লিপ। অনেকেই দাবি করছেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম ও নেতাদের এরকম দ্বিমুখী নীতি ও কার্যকলাপের জন্যই এত খারাপ চেহারা নিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাত।
- সূত্র: বিবিসি হিন্দি, দ্য নিউ আরব