রাশিয়ার প্রভাবে চীনা ইউয়ান কি একটি বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে উঠতে পারবে?
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং দেশটির উপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চীনকেও প্রভাবিত করছে পরোক্ষভাবে। রাশিয়া একঘরে হয়ে যাওয়ার ফলে চীনা ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণ ও বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে ওঠার প্রয়াসে ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
এখন উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে রাশিয়াকে। যে কারণে অর্থ স্থানান্তরের জন্য রাশিয়ার নিজস্ব পেমেন্ট ব্যবস্থা এসটিএফএম এবং চীনের ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেমের (সিআইপিএস) উপর নির্ভর করতে হচ্ছে দেশটিকে।
এসটিএফএমের পরিধি ছোট হওয়ায় বৈশ্বিক লেনদেনের জন্য মূলত সিআইপিএসের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। রাশিয়ার প্রভাবে কি তবে বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারবে চীন?
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল গত সপ্তাহে সিনেট ব্যাংকিং কমিটির শুনানিতে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার লক্ষ্যে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন, তার গতিপথ বদলে দিতে পারে এই যুদ্ধ।
কিন্তু সিআইপিএস বা অন্য কোনো সিস্টেম সুইফটের বিকল্প হতে পারবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। গবেষণা সংস্থা রোডিয়াম গ্রুপ বলেছে, মাত্র ৭৫টি সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ে সুইফটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না সিআইপিএস। সংস্থাটি আরও বলেছে, চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং মূলধন নিয়ন্ত্রণের মৌলিক সীমাবদ্ধতার জন্য ইউয়ানের আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে উঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এডউইন লাই বলেন, "চীন এখন দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। একদিকে, মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণের জন্য মরিয়া তারা। কিন্তু অন্যদিকে, তাদের অর্থনীতির নেট লেনদেনের হিসাব দিতে এবং আর্থিক খাতের উদারীকরণ করতে অনিচ্ছুক দেশটি।"
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুদ্রা রিজার্ভের হিসাবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মুদ্রা ইউয়ান। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো ২০২১ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে প্রায় ৩১ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের ইউয়ান ধারণ করেছে।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা জেরেমি মার্ক বলেন, "ডলারের কর্তৃত্বের মাঝে ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণের সম্ভাবনা এখনও ফ্যাকাশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হোল্ডিং ইউয়ানের মোট রিজার্ভের মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই তুলনায় ডলার তার মোট রিজার্ভের ৫০ শতাংশেরও বেশি।"
তিনি যোগ করেন, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য পরিচালনায় ইউয়ান ব্যবহৃত হলেও এর ব্যবহার এখনও সীমিত। এছাড়া, চীনের নিরাপত্তা উদ্বেগের জন্য বড়সড় বৈশ্বিক বিনিয়োগে ইউয়ান ব্যবহার করা হয় না।
"এর পিছনে মূল কারণ হচ্ছে, দেশে এবং দেশের বাইরে পুঁজির স্বাধীন লেনদেনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে চীন। এবং ইউয়ান নিজেও স্বাধীনভাবে বাণিজ্য যোগ্য নয়," বলেন মার্ক। মুদ্রার উপর হস্তক্ষেপ বন্ধ না করলে ইউয়ানের আন্তর্জাতিক প্রভাব সীমিত থেকে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্যের হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। গত বছর নিজেদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করেছে এই দুটি দেশ, যা তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই অঙ্কটি আগের বছরের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি এবং ২০২১ সালে রাশিয়ার সামগ্রিক বাণিজ্যের প্রায় ১৮ শতাংশ।
কিছু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাবকে প্রশমিত করতে মস্কোতে অবস্থিত চীনা রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কগুলোতে নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার চিন্তা করছে রুশ সংস্থাগুলো।
লাই বলেন, "রাশিয়া তার লেনদেনে ইউয়ান যতই ব্যবহার করুক না কেন, মুদ্রাটির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতায় তাতে খুব বেশি হেরফের হবে না। রাশিয়ার অর্থনীতি তেমন ব্যাপক না। বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র দুই শতাংশ রাশিয়ার।"
এছাড়া, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে চীন-রাশিয়া অক্ষের উপরও নেতিবাচক দাগ পড়েছে। ট্রান্সন্যাশনাল চায়না কনসাল্টিংয়ের পরিচালক ডেভিড জুইগ বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বন্ধুত্ব তথাকথিত নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় এই অক্ষকে 'স্বৈরাচারী' তকমা দিয়ে দিচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক ইমেরিটাস বেঞ্জামিন কোহেন বলেন, "একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কারণেই বাজারে এই মুদ্রার জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে। কারণ, এখানে ইস্যুকারী সরকারের পক্ষ থেকে সম্পত্তির অধিকারকে সম্মান দেওয়া এবং চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয় না।"
লেখক-অধ্যাপক লাই তার বইয়ে অনুমান করেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থপ্রদানের ক্ষেত্রে তৃতীয় বৃহত্তম মুদ্রা হয়ে উঠতে পারে ইউয়ান। মার্কিন ডলার এবং ইউরোর পিছনে থেকেও মোট লেনদেনের ৬ থেকে ৭ শতাংশের দখল নিয়ে নিতে পারে চীনা মুদ্রাটি। বর্তমানে ২ শতাংশেরও কম লেনদেন হয় এ মুদ্রায়।
বেইজিংয়ের চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক মার্কাস ভিনিসিয়াস ডি ফ্রেইটাস বলেন, "মার্কিন ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে ইউয়ানকে প্রথমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে হবে।"
আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুবিধার্থে চীনের বৈশ্বিক সেটেলমেন্ট ও ক্লিয়ারিং ব্যবস্থাকে উন্নত করারও পরামর্শ দেন তিনি। এবং যোগ করেন, "এক্ষেত্রে বিশ্বাসই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে।"
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট