আরেকটি যুদ্ধ, আরেকটি হৃদয় ভাঙার গল্প!
যুদ্ধ নিয়ে আমাদের সকল রোমাঞ্চের ইতি টেনে পুতিন সাহেবের গ্যারিসন এখন কিয়েভ, খারকিভ থেকে মারিয়োপোলের পথে-প্রান্তরে রণক্ষেত্রে লিপ্ত। যারা এতোদিন ভাবতেন একুশ শতকে আর যুদ্ধ হবে না 'রাজায় রাজায়' তাদের ভুল প্রমাণিত করলো হাজার হাজার প্রজার প্রাণ, জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার এই পৃথিবীতে যতদিন জাতিস্বার্থই মুখ্য হয়ে থাকবে ততদিন অবধি যুদ্ধও অনিবার্য পরিণতি। আর সংঘাতও চলমান থাকবে, গোটা পৃথিবী নিজেদের সব বিরহ বেদনা থেকে একটুখানি অবসর নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকবে যুদ্ধের অ্যাকশন দৃশ্যে, যেভাবে তারা মত্ত হয় চলচ্চিত্রের মারপিটে, আমরাও কোন এক পল্টনে ভিড়ে হিসাব কষব যুদ্ধের, এই যেমন পূর্ব ইউরোপের এই যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের হিসাব ইতোমধ্যে কষা শুরু হয়ে গেছে! ফিলিস্তিনের কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন "যুদ্ধ শেষ হবে নেতারা আবার মিলিতো হবেন আর বৃদ্ধ মা বুক বাঁধবেন তার শহীদ সন্তানের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায়"। এভাবে রঙিন দুনিয়ার সাজিয়ে দেওয়া নায়ক-খলনায়ক বাইনারির ছাঁচে পড়ে একদিন ইতিহাস থেকে মুছে যাবে হাজার হাজার হৃদয় ভাঙার গল্প।
পাতার পর পাতা জুড়ে লেখা বিশ্লেষণে যুদ্ধের তো একটা গতি হবেই কিন্তু মানবতার যে আরেকবার পরাজয় হলো তার খবর আমাদের কাছে কি গুরুত্ব পেলো? ইতোমধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১৭ লাখ মানুষ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে এই সংখ্যা ৪ মিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে সামনে। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, 'হতে পারে এই যুদ্ধ ইউরোপের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে বীভৎস অধ্যায় তবে আমাদের জন্য আর আট-দশটা দিনের মতই'! হয়ত তারাই ঠিক- ঔপনিবেশিক সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিন, ইরাক হয়ে আফগানিস্তান জুড়ে বোমার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত নির্মমতার কাছে এসব নতুন কিছু নয়। তাই বলে পশ্চিম রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেভাবে একাট্টা, আমাদের দুঃসময়ে সেভাবে পাশে থাকে না বলে, ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের এই দুর্দশায় পাশে না থাকাটা আমাদেরও ঔপনিবেশিক মননের অধিকারী করে তুলবে। অন্তত নৈতিক দিক থেকে হলেও এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করা জরুরি।
সব দোষ কেষ্ট বেটারই?
কিন্তু প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে? আমাদের প্রতিবাদের ভাষা কি শুধুই পশ্চিমা গণমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক প্রতিবাদ দোষে দুষ্ট? সব নষ্টের গোড়াই এই পুতিন নাকি অন্যরাও কম যান না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই সংকট বুঝতে হলে আমাদের তাই ফিরতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।
বলা হয় কিছু কিছু চলচ্চিত্রের নিজের একটা ভাষা থাকে "লাইফ ইজ বিউটিফুল"(১৯৯৭) ও তেমনই এক দুর্দান্ত হৃদয় ভাঙার জবাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেরা ছবিগুলোর একটি বললে ভুল হবে না একদম, শেষ দৃশ্যে বাবার জীবনের বিনিময়ে ছেলের বিজয়ের হাসি আমাদের ব্যথাতুর করেছে, অদৃশ্যভাবে হয়ে উঠেছে নাৎসিদের সব বর্বরতার এক প্রামাণ্য দলিল রূপে। কিন্তু ইতিহাস তো বিজয়ীরাই লেখে! নেতাদের সিদ্ধান্তের বলি হতে হয় সাধারণ জনগণকেই, সিনেমার কুখ্যাত হিটলারের জন্ম যে ভার্সাই চুক্তির অন্যায্যতার ফসল সেই ইতিহাস চিত্রায়নের অভাবে কি বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল?
আমাদের যুগের মিত্রশক্তিরা হয় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন নাই, নয়তো নির্ঘাত জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঠ তৈরি করে দেওয়ার প্রেক্ষাপট ভুলে গেছেন, তাই নতুন করে আজকের পুতিনের জন্ম।
পশ্চিমারা চাইলেই আজকের উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে অনেক আগেই সরে আসতে পারতো কিন্তু রাশিয়াকে উস্কে দেওয়ার দায় তারা কোনভাবেই এড়াতে পারে না। যুদ্ধ না হলে 'মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স' চলবে কিভাবে, যুক্তরাষ্ট্র নিজের 'ডিক্লাইনিং হেজেমনিকে' তো আর এমনিতেই চীনের কাছে হাতছাড়া করতে পারে না!
অনেকদিন ধরেই ক্রেমলিন দাবি করে আসছিলো পূর্ব ইউরোপে তারা ন্যাটোর কোনরূপ সম্প্রসারণ মেনে নিবে না তার পরেও ন্যাটো বরাবরই ইউক্রেনকে তার বলয়ে টানতে সচেষ্ট ছিলো। রাশিয়া গতবছর থেকেই যুদ্ধের হুমকি দিয়ে আসছিলো, এবং অনেকেই ধারণা করছিলেন কিয়েভ দখল তাদের জন্য স্রেফ কিছু সময়ের ব্যাপার। সেটা ভুল প্রমাণিত করে ইউক্রেন ভালোই প্রতিরোধ করেছে রুশদের প্রথম সপ্তাহে, তবে এরপর থেকে শুরু হওয়া রাশিয়ার বড়মাত্রার হামলায় আর কয়দিন জেলেনস্কির সরকার টিকে থাকবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে কোন পক্ষই ছাড় দিতে নারাজ আর যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হবে ততই জটিল হয়ে উঠবে পরিস্থিতি, আর্থিক ধকল সামলে রাশিয়ার জন্য বড় সময় ধরে টিকে থাকাও চ্যালেঞ্জিং বটে। সাথে সাথে দুই দিকেই যোগ দিচ্ছে প্রক্সি যোদ্ধারা, এমন হলে এই সংঘাত সহজেই প্রবাহিত হবে ভিন্ন খাতে। সেই অর্থে আলোচনায় বসা ছাড়া কোন পথ খোলা নেই কারোরই, শরণার্থী সংকট কাটাতে হলেও কিয়েভে স্থবিরতা দরকার ইউরোপের জন্য। সেইসাথে হু হু করে বাড়ছে তেলের দাম।
আলোচনার জন্য রাশিয়ার শর্ত প্রথমত, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে, এরপর লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি আর সর্বশেষ ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার সম্মতি পেলে তারা সামরিক পদক্ষেপ থেকে সরে আসবে বলছে। অন্যদিকে জেলেনস্কি রুশদের বিপক্ষে যুদ্ধের ময়দানে ভালোই দৃঢ়তা দেখালেও একই সাথে তার ভুল সিদ্ধান্ত দুই পরাশক্তির মাঝে ইউক্রেনের আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী। ফলপ্রসূ আলোচনার অভাবে এখনো পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই, মাঝে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি হলেও তাও কার্যকর হয় নাই দু'পক্ষের সমন্বয়ের অভাবে।
এই যুদ্ধে সব থেকে লাভবান হওয়া যুক্তরাষ্ট্র কি চায় তার ওপরও নির্ভর করছে কোন দিকে মোড় নিবে কিয়েভের পরিস্থিতি। চীন, রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে থাকা ইউরোপীয় মিত্রদের আবার নিজের বলয়ে ফিরিয়ে আনা পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে? অস্ত্র বাণিজ্য নাকি শান্তির জয়ধ্বনি, সেটাও দেখার বিষয়।
দুদিকে দোদুল্যমান তুরস্কও শেষপর্যন্ত কোনদিকে যায় বলা যাচ্ছে না, ইউক্রেন-রাশিয়া উভয়ের সাথেই তার আছে গভীর সংযোগ। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জবাবে রাশিয়ার বড় ভরসার জায়গা চীনও কূটনৈতিক নিরপেক্ষতার আড়ালে ঠান্ডা মাথায় মোকাবেলা করতে চাচ্ছে পরিস্থিতি। অন্যদিকে যুদ্ধ দমাতে ব্যর্থ ইইউ এর ভূমিকা আসলে হ্রাস পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে আসছে।
দিনশেষে যুদ্ধের জন্য কারা দোষী- এই বৃত্তের বাইরে এসে সংঘাত পেছনে ফেলে সামনে আগাতে হলে সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে নতুন উদ্যমে, নয়ত হৃদয় ভাঙ্গবে এই পৃথিবীর বারবার।
- লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়