উড়িষ্যার এই দিনমজুর যেভাবে ইউটিউব তারকা হয়ে ওঠলেন
করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে গত দুই বছরে চাকরি হারিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। মূলত লকডাউনের কারণে অনেকেই আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদেরই একজন ছিলেন ভারতের উড়িষ্যার বাসিন্দা ইসাক মুন্ডা।
কিন্তু লকডাউনে আটকে পড়া আর দশজনের মতো প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেননি তিনি; বরং দেখিয়ে দিয়েছেন যে ইচ্ছা থাকলে সব বাঁধা পেরিয়েও তারকার মতো জ্বলে ওঠা যায়!
মহামারির আগে ইসাক মুন্ডা কাজ ভবন নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন। দিনমজুরিই ছিল তার পেশা। কিন্তু ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কায় গণহারে কর্মী ছাঁটাই করতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। ইসাক মুন্ডাও রেহাই পাননি এই দুর্ভাগ্যের হাত থেকে। মহামারিতে বেকার জীবন কাটানোই যখন নিয়তি ধরে নিয়েছিলেন, তখন হঠাৎ এক অনুপ্রেরণা পান তিনি!
ইসাক মুন্ডার সন্তানেরা একদিন ইউটিউবে কার্টুন দেখছিল। সেখানেই তিনি শুনতে পান একটি কণ্ঠ… কিভাবে ঘরে বসে ভিডিও আপলোড দেওয়ার মাধ্যমেই টাকা আয় করা যায়!
এরপর ইসাক ভাবলেন, তাহলে একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক! অন্যান্য ইউটিউব ভিডিও ঘেঁটে আরও তথ্য যোগাড় করলেন। শুরুটা করলেন খাবারের ভিডিও আপলোড দেওয়ার মাধ্যমে।
প্রথম ধাক্কায়ই বাজিমাত করার মতো কিছু ইসাক মুন্ডার সাথে ঘটেনি। নিজের প্রথম ভিডিওতে তিনি এক প্লেট খাবার নিয়ে বসেছিলেন; তাতে ছিল ডাল, ভাত, সবজি, টমেটো ও মরিচ। দর্শকদের অভিবাদন জানিয়ে শুরু করেছিলেন, বাকিটা নিঃশব্দে খাওয়ার মাধ্যমেই শেষ হয়।
প্রথম এক সপ্তাহ কেউই ইসাকের ভিডিও দেখেনি। জানালেন, কোনো ভিউ না হওয়ায় বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। ইউটিউবের কাছেই চাইলেন সাহায্য, দেখলেন অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের ভিডিওর প্রচার চালাচ্ছে।
তাই ইসাকও একটি ফেসবুক আইডি খুলে সেখানে নিজের ভিডিও শেয়ার দেওয়া শুরু করলেন। এবার ১০-১২ জন মানুষ তার ভিডিও দেখল।
উড়িষ্যার জনপ্রিয় খাবার 'বাসি পাখালা'র ভিডিও আপলোড দেওয়ার মাধ্যমে দ্রুত ভাইরাল হয়ে গেলেন ইসাক। বাসি পাখালা হলো গাঁজন প্রক্রিয়ায় বানানো এক ধরনের খাবার।
ইসাক বলেন, "এই ভিডিও দিয়ে আমি একদিনেই ২০,০০০ সাবস্ক্রাইবার পেয়ে যাই। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, মঙ্গোলিয়াসহ বিশ্বের নানা দেশের মানুষ এই ভিডিওটা দেখেছিল।"
আর এখান থেকেই এগিয়ে যাওয়া শুরু ইসাক মুন্ডার।
দুই বছর পর এখন তার ইউটিউব চ্যানেল 'ইসাক মুন্ডা ইটিং' এর সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা আট লাখ। দশ কোটিরও বেশি বার তার ভিডিওগুলো দেখেছে মানুষ। এখন বেশ স্বচ্ছন্দেই 'গ্রামে চিকেন পার্টি' আর পরিবারের সাথে খাওয়াদাওয়ার ভিডিও নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির হন ইসাক।
'ব্লেন্ডিং কালচার অ্যান্ড কুইজিন' নামক মাসিক রেডিও শো দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন উড়িষ্যার এই ইউটিউবার। এমনকি গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে নিজের অনুভূতি জানিয়ে ইসাক বলেন, "আমি যেন তখন খুশিতে সপ্তম স্বর্গে অবস্থান করছিলাম! আমার সাবস্ক্রিপশনও তখন অনেক বেড়ে যায়।
ইউটিউব দিয়েই বাজিমাত!
বিপুল পরিমাণ খাবার সামনে নিয়ে খেতে খেতে ভিডিও করার 'মুকব্যাং' ট্রেন্ডও অনুসরণ করেছেন ইসাক। ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে প্রথম এরকম ভিডিওর ট্রেন্ড শুরু হয় এবং দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মুকব্যাং চ্যানেলগুলোরও রয়েছে লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবার। ভারতে 'ম্যাডিইটস' চ্যানেলটিও মুকব্যাং এর জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়।
অনেক দর্শকই জানিয়েছেন, তারা খাওয়ার সময় মুকব্যাং ভিডিও দেখতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে, একা খেতে বসলে এটি তাদের নিঃসঙ্গতা দূর করে।
তবে ইসাক এসবের কিছুই জানতেন না। খাবার নিয়ে ভ্লগিং শুরু করার আগে তিনি স্রেফ শখের বসেই বিভিন্ন ভিডিও বানিয়েছিলেন। তিনি তার স্ত্রী যেসব খাবার তৈরি করতে পারেন, সেগুলোই তিনি ভিডিওতে দেখাতেন।
ইসাক বলেন, "আমি ভেবেছিলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবন কেমন তা দেখতে দর্শকরা আগ্রহী হবেন।"
আর ইউটিউবার হতে গিয়ে খোদ ইউটিউবের সাহায্যই সবচেয়ে বেশি নিয়েছেন ইসাক। কোন ক্যামেরা কিনতে হবে, কিভাবে শুট ও এডিট করতে হবে, এমনকি খাবারের রেসিপিও তিনি ইউটিউবেই শিখেছেন।
ভিডিও বানাতে স্মার্টফোন কেনার জন্য ৩০০০ রূপি তোলেন ইসাক, যা ওই সময় তার জন্য একটা বড় অংকের টাকা ছিল। এই টাকাও তাকে কিস্তিতে শোধ করতে হয়েছিল।
ইসাক মুন্ডার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। স্কুলের গণ্ডি পেরোননি তিনি, তবে টুকটাক ইংরেজি জানেন। তবুও নিজে নিজেই ইমেইল পাঠানো থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের চ্যানেলের প্রচারণা চালানোর কাজটি ভালোই রপ্ত করেছেন তিনি। এমনকি নিজের ভিডিওতে সাবটাইটেল জুড়ে দেওয়ার জন্য গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করতেও শিখেছেন তিনি।
দিন দিন নিজেকে আরও উন্নত করে তোলার দিকে মনোযোগী হয়েছেন ইসাক। প্রথম ভিডিওতে তিনি হিন্দিতে 'হ্যালো বন্ধুরা। আমি আজ এই প্লেটে যা যা আছে সেগুলো খাবো' বলে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে তার ভিডিওর ধরন পালটে গেছে। এখন আর তিনি নিত্যদিনের খাবারের ভিডিও বানান না। শুধুমাত্র বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান বা 'ভিলেজ পার্টি'র মতো দিনগুলোতেই তিনি ভিডিও বানান।
ইসাকের ভিডিওগুলোতে কমেন্ট করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ভারতীয়রা। তারা তার কন্টেন্টগুলো দেখে মজা পান। তার কৃত্রিমতা-বর্জিত জীবনের প্রশংসা করেন অনেকে। আবার অনেকেই মনে করেন, তিনি খাবারের কদর করতে জানেন এবং খাওয়াদাওয়াকে উপভোগ্য বিষয় করে তোলেন।
এছাড়া, ভক্তদের অনুরোধে বাড়িতে তৈরি খাবারের পাশাপাশি বাইরের বিভিন্ন খাবারও ট্রাই করেন তিনি। উত্তর ভারতের আলু পরোটা, আলুর পুরভর্তি পুরি, চাওমিন ইত্যাদি খাবার নিয়েও হাজির হয়েছেন এই ইউটিউবার।
খাবারের মেন্যুতে ফুড চ্যালেঞ্জকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন ইসাক মুন্ডা। তিনি বলেন, "আমরা এখনো প্রতিদিন খুব সাধারণ খাবার খাই।" তবে এখন আগের চেয়ে বেশি খাওয়ার সুযোগ হয় তাদের, একথা অস্বীকার করেননি তিনি।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ
দিনমজুর হিসেবে কাজ করার সময় দৈনিক ২৫০ রূপি আয় করতেন ইসাক মুন্ডা। মাসে ১৮ থেকে ২০ দিন কাজে পেতেন তিনি। বলাই বাহুল্য, এই স্বল্প আয়ে তার ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ স্বচ্ছন্দে চলতো না।
কিন্তু ইউটিউব চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইসাক মুন্ডার মাসিক আয় এক লাফে ৩ লাখ রূপিতে গিয়ে পৌঁছেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা!
তবে চ্যানেলের ভিউ কমে গেলে তার আয়ও কমে যায়। এখন তার মাসিক আয় ৬০,০০০-৭০,০০০ রূপি।
তা সত্ত্বেও ইউটিউব থেকে যে আয় করেন তা দিয়েই ইসাক তার পুরনো ভাঙাচোরা ঘরের জায়গায় দুইতলা দালান উঠিয়েছেন। তিনি জানান, এই বাড়িটি তৈরি করতে তার দুই লাখ রূপি খরচ হয়েছে।
শুধু তাই নয়, সন্তানদের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের জন্যও টাকা জমাচ্ছেন ইসাক। কিনেছেন একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি এবং ল্যাপটপও।
নিজ এলাকায় রীতিমতো সেলিব্রেটি বনে গেছেন ইসাক মুন্ডা! প্রায়ই গ্রামের মানুষদের জন্য জমকালো পার্টি দেন তিনি।
নিজের সন্তানদের শহরের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে চান ইসাক। তিনি বলেন, "আমি তাদেরকে যতটা সম্ভব খুব পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে চাই। আমার সীমিত জ্ঞান নিয়ে যদি আমি এতদূর আসতে পারি, তাহলে যারা উচ্চশিক্ষিত তারা আরও ভালো করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস!
সূত্র: বিবিসি।