ঢাকার ভেতরেই ৬০০ নৌকা পারাপারের কথা বলছি…
ব্যস্ত এলাকা সদরঘাটের এই অংশ। একদিকে ওয়াইজঘাট। অদূরেই বাবুবাজার সেতু। উপরের ঐ সেতু দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন পার হচ্ছে। তার নিচেই বুড়িগঙ্গার দুদিকের পারে শত শত নৌকা। এসব ছোট ডিঙি নৌকা দিয়েই পার হচ্ছে শত শত মানুষ। সদরঘাটের ওয়াইজঘাটে গেলে এই ব্যস্ত মানুষের নৌকা পারাপার চোখে পড়বে।
বুড়িগঙ্গার অপরপাশেই কেরানীগঞ্জ অবস্থিত। পাঞ্জাবি, দেশি, আর নানা কাপড়ের বিশাল পাইকারি বাজার। প্রতিনিয়তই মানুষ কেরানীগঞ্জসহ ওপারের এলাকায় যাতায়াত করতে ব্যবহার করে চট জলদির নৌকা।
গত বৃহস্পতিবারে সদরঘাটে গিয়েছি। ওয়াইজঘাটে পাঁচ টাকা টিকিটের বিনিময়ে প্রবেশ করে দেখতে পাই সেখানকার নৌকাগুলো মানুষ এবং হরেক রকম মালামাল পরিবহনে শশব্যস্ত। মাঝিদের হাকডাকে সরগম হচ্ছে ওয়াইজঘাট।
'রিজার্ভ নৌকা ৩০ টাকা' বলে যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে দেখলাম একজনকে। কাছে যেতেই ওপারে যাবো কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে নিজের নৌকায় গিয়ে বসতেই এক লোক এলেন তার কাছে। প্রায় বিশটি চটের কার্পেট নিয়ে এসেছেন তিনি। গন্তব্য কেরানীগঞ্জের ইস্পাহানী ঘাট।
একটু পরে কার্পেট বোঝাই করা নৌকাটিতেই উঠে বসলাম। আশেপাশের নৌকাগুলোকে এক রকম ধাক্কাধাক্কি করে সরিয়ে দিয়ে আমরা বুড়িগঙ্গার ওপারে যাচ্ছি। কেরানীগঞ্জের হাসান আলি নৌকাপথে কার্পেট ছাড়াও গত পাঁচ বছর অন্যান্য পণ্য পরিবহন করছেন।
আমাদের পাশ কাটিয়ে আরো কিছু নৌকা যাত্রী এবং মালামাল বহন করছে। শোয়ারি ঘাট, মিটফোর্ড ঘাট, বাবুবাজার ঘাট, শ্যামবাজার ঘাটসহ পুরো সদরঘাটে এরকম নৌকা রয়েছে প্রায় ৬০০টি। আকারে ছোট এই নৌকাগুলো হালকা পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন করে থাকে।
মাঝারি আকারের আমাদের এই নৌকার মাঝি নিজাম উদ্দিন। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। নৌকার মাঝি হওয়ার অভিজ্ঞতা জিজ্ঞাসা করলাম। নৌকার বৈঠা হাতে রেখেই জানালেন এই নৌকাটি মূলত তার বড় মামা রাজেক আলমের। পাঁচ বছর আগে প্রায় ৫ হাজার টাকা দিয়ে নৌকাটি কিনেছিলেন রাজেক আলম।
ছোটবেলায় কামরাঙ্গীরচরে মামার বাড়িতেই বড় হয়েছেন নিজাম উদ্দিন। গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতপুরে। তবে কৈশোরে পিতামাতা মারা যাবার পরে গ্রামে খুব একটা যাওয়া হতোনা তার। এরপর বড় মামার সাথেই থাকতে শুরু করেন। স্থানীয় একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তিনি। মামাতো বোনের বিবাহ হয়ে যাবার কিছুদিন পরে তার মামা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর থেকেই গত ১০ বছর ধরে ওয়াইজঘাটে নৌকায় পারাপারের কাজে আছেন তিনি।
কথার মাঝে বললেন, নৌকার মাঝি হবার আগে নবাবগঞ্জে একটি হোটেলে কর্মচারী ছিলেন তিনি। তখন মামার বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে নবাবগঞ্জে একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। দীর্ঘদিন ধরে ঐ হোটেলে কাজ করলেও বেতন বাড়েনি খুব একটা। সেখানে মাসে মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতন পেতেন তিনি। বেতন বৃদ্ধি নিয়ে হোটেলের মালিকের সাথে তার বিরোধ বাঁধলে হোটেলের চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর মামার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে চালাতে পরামর্শ দেন। প্রথমদিকে ঘাটের অন্যান্য মাঝিদের সাথে ঝামেলা হলেও আস্তে আস্তে তা ঠিক হয়ে যায়।
নিজাম উদ্দিন বলেন, "যেকোনো নতুন জায়গায় কাজশুরু করলে অন্যান্যরা যে একটু সমস্যা করে।"
প্রতিদিন কী পরিমাণ যাত্রী বা মালামাল পরিবহন করেন তিনি জানতে চাইলে নিজাম উদ্দিন বলেন, "অন্যদের কথা বলতে পারিনা। আমার নৌকায় যাত্রী আর মালামাল সবই নিই। যাদের ছোট নৌকা তারা শুধু ২-৪ জন যাত্রীই পরিবহন করে। আমার মতো মাঝারি আকারের নৌকাতে মালামালের পাশাপাশি যাত্রীও নেওয়া যায়। যাত্রী পারাপারে ১০ টাকা আর পুরো নৌকা রিজার্ভ নিয়ে নদী পার হতে ৩০ টাকা করে লাগে।"
নিজাম উদ্দিন জানালেন, প্রতিদিন একই পরিমাণ যাত্রী হয়না। একদিন বেশি যাত্রী হলে আরেকদিন হয়তো মালামাল বেশি টানতে হয়। যাত্রী বা পণ্য পরিবহন করে প্রতিদিন প্রায় ছয় থেকে সাতশো টাকা আয় করেন তিনি। পুরো নৌকা বোঝাই করে পণ্য পরিবহন করতে স্থানভেদে ২০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন নিজাম উদ্দিন।
তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাত্রী এবং মাঝির মধ্যে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ রয়েছে।
পণ্য পরিবহনে ডিঙ্গি নৌকা
কেরানীগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে শুকনা খাবার আর ফলভর্তি আরও কিছু নৌকা দেখতে পাই। এই নৌকাগুলো মিটফোর্ড ঘাটে যাবে। এসব পণ্যের গন্তব্য মিটফোর্ডে হাসপাতালের পাশে অবস্থিত পাইকারী ফলের আড়তে।
একজন ফল ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এরকম ছোট দূরত্বে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নদীপথেই সুবিধা বেশি। কারণ হিসাবে জানালেন, কেরানীগঞ্জ থেকে বাদামতলী ফলের বাজারে স্থলপথে মালামাল পরিবহন করতে গেলে সময় এবং খরচ দুটোই বৃদ্ধি পায়। যানজট এবং ভাড়া বেশি হবার কারণে ভ্যানগাড়ির চেয়ে নৌকাতে পণ্য পরিবহন করা সাশ্রয়ী বলে মনে করেন এসব ব্যবসায়ীরা। একই কথা প্রযোজ্য যাত্রী পরিবহণের ক্ষেত্রেও।
বেশ কয়েকজন যাত্রীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলি। তাদের কেউ কেউ মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানান। ওয়াইজঘাট থেকে কালীগঞ্জে যাবেন এমন এক যাত্রী বললেন, "এখান থেকে কালীগঞ্জ যেতে হলে আমাকে বাবুবাজার সেতু পার হয়ে যেতে হবে। এতে সময় লাগবে অনেক। এই সেতুতে প্রায়শই যানজট থাকে। আর এই ঘাট থেকে কালীগঞ্জ ঘাটে সরাসরি পৌঁছানো যায় খুব সহজেই। ১০ মিনিটের মধ্যেই আপনি পার হতে পারবেন।" বোঝা গেল মূলত সময় বাঁচাতেই যাত্রীরা নৌকায় পারাপার হয়ে থাকে।
প্রবীণ মাঝির চোখে বুড়িগঙ্গা
সদরঘাট থেকে ফেরার সময় হয়ে এসেছিল। ওয়াইজঘাটে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। এক মাঝির সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম, এখানে বেশ কয়েকজন মাঝি আছেন যারা বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যাত্রী পারারপারের কাজে নিয়োজিত।
সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ পরে এমনই একজনের সাথে কথা হলো। নাম তার আব্দুল হালিম। ষাটোর্ধ্ব এই মাঝি সদরঘাটে আছেন প্রায় ১৫ বছর। ছোট একটি নৌকার মালিক তিনি।
বুড়িগঙ্গা নদীর আগের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলাম তার কাছে। জানতে পারলাম আব্দুল হালিম যখন এখানে নতুন মাঝি তখনও বুড়িগঙ্গার পানি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। বর্তমানে বর্ষাকালে যেমন নদীর পানি কিছুটা ঘোলাটে বর্ণ ধারণ করে, তখন প্রায় সারা বছরই এমন পানি দেখেছেন আব্দুল হালিমসহ অনেকেই।
বর্তমানের প্রসঙ্গে তিনি 'উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট' প্রবাদটিই আওড়ালেন। প্রবাদের সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে যেন কোনো বেগ পেতে হয়না।
তিনি বললেন, "আগে যাত্রী পারাপারের সময় অনেকেই নদীর পানিতে হাত দিতো, পা ভেজাতো। কিন্তু এখন বুড়িগঙ্গার পানি এতই অপরিষ্কার হয়েছে যে, কেউ আর এই পানি ছুঁতেও চায় না।"
বাস্তবেই তো দেখতে পাই বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়েই হেঁটে চলা কষ্টকর। নোংরা-আবর্জনা আর ট্যানারির বর্জ্যে নদীর পানি কালো বর্ণ ধারণ করে থাকে সারা বছরই। আগে নৌকা পারাপারের স্মৃতি মনে করে আব্দুল হালিম বলেন, "এখানে আগে এক-দুই টাকা দিয়েও মানুষ নদী পার হতো। তখন নদীতে দুর্গন্ধও ছিল না। পূর্বের মাঝিদের কাছে শুনেছি লঞ্চ চালু হবার আগে নদীতে ময়লা কম ছিল। এখন লঞ্চের ময়লার সাথে সাথে বিভিন্ন কারখানার ময়লা পানিও নদীতে মিশে গেছে।"
আর কতদিন এই পেশায় থাকতে চান- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, "নৌকা চালিয়েই তো আমরা জীবনধারণ করলাম। পেশা পরিবর্তনের আর সুযোগ নেই এখন। যতদিন বেঁচে থাকি এখানেই আছি। প্রতিদিন যা রোজগার করি তাতেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করি।"