আলেক্সান্ডার দুগিন: পুতিনের প্রিয় দার্শনিক, ইউক্রেন যুদ্ধের রূপকার!
রাশিয়ার বাইরে আলেক্সান্ডার দুগিন নামটি বোধহয় খুব কম মানুষই জানেন। অথচ তার বিশ্বদর্শনের পরিণাম আজ বইছে লাখ লাখ মানুষ।
আলেক্সান্ডার গ্যালেভিচ দুগিন, ১৯৬২ সালের ৭ জানুয়ারি রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। একাধারে তিনি একজন রুশ দার্শনিক, অধ্যাপক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কৌশলবিদ। তিনি ন্যাশনাল বলেশেভিক ফ্রন্টের প্রধান সংগঠক এবং একইসাথে ভ্লাদিমির পুতিনের দল- ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য।
রাজনৈতিক দার্শনিক থেকে সত্যিকারের রাজনীতিক হয়ে উঠার উদাহরণ দিয়েই কেবল দুগিনকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তার ধর্মচিন্তাও সুদূরপ্রসারী। রাশিয়ার খৃষ্টধর্মে রুশ অর্থোডক্স চার্চের নিয়ন্ত্রণ বেশি । কিন্তু, দুগিন বিভিন্ন সময়ে এ চার্চে হওয়া সংস্কারগুলোর বিরোধী একটি আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীর সদস্য।
তার সবচেয়ে বড় প্রভাব রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি- প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর। দুগিনের চিন্তা ও দর্শনে প্রেসিডেন্টের আস্থার কারণেই তিনি "পুতিনের দার্শনিক" বলেই পরিচিত।
দুগিন প্রাচীন ভাবধারার মানুষ। তিনি আধুনিক জীবনের জটিলতাগুলোর বিরোধী। প্রযুক্তিতে তার আস্থা নেই, চান ইন্টারনেটের বৈশ্বিক জাল বন্ধ করে দেওয়া হোক। আসলে তিনি একজন আধুনিকতাবাদ বিরোধী। সহজভাবে বলা যায়, তিনি আধুনিক বিশ্বব্যবস্থাকে বৈপ্লবিকভাবে পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেন।
আর ঠিক এ জায়গাটিতেই তার চিন্তাভাবনা পুতিনের সিদ্ধান্তে বড় ছাপ ফেলে বলে ব্যাখ্যা করেছে দ্য জিউইশ ক্রনিকল।
ইহুদিবাদী গণমাধ্যমটির দাবি, দুগিনের বিশ্বদর্শন জার্মান দার্শনিক মার্টিন হেইডেগার দ্বারা অনুপ্রাণিত। হেইডেগার নাৎসিদের সাথে যোগ দেন, জাতি ও বর্ণগত বিভাজন সম্পর্কে তাদের দীক্ষিত করতে পরিচালনা করেছেন হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়।
হেইডেগারের মতো দুগিনও প্রযুক্তিকে মানুষের মৌলিক পরিচয় ও সত্ত্বার ক্ষয়কারী হিসেবে দেখেন। তাদের স্থির বিশ্বাস- প্রযুক্তির এই আধিপত্যের মাধ্যমে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় রেখে নিয়ন্ত্রণ করছে এক শ্রেণির 'বৈশ্বিক অভিজাত'।
দুগিনের প্রতি-বিপ্লবের লক্ষ্য তাই পশ্চিমা দুনিয়ার প্রচারিত মানবাধিকার, ব্যক্তি-স্বাধীনতার অবসান। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞান ও ইন্টারনেট আধিপত্যের অবসান।
১৯৯৭ সালে রাশিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুগিনের একটি ভূরাজনীতি বিষয়ক বইকে পাঠ্যক্রম ভুক্ত করা হয়। 'ফাউন্ডেশন অব জিওপলিটিক্স' নামের এই গ্রন্থে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন থেকে ভ্লাদিভস্তক—সমগ্র ইউরোপে রুশ শাসনের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন তিনি। আর এ শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক শক্তি, অপপ্রচার ও রাশিয়ার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে উদ্দেশ্যসাধনের শক্তি হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
ইউরেশিয়া (ইউরোপ ও এশিয়া) বলতে দুগিন নতুন রুশ সাম্রাজ্যকেই বুঝিয়েছেন—যে সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক ও অপরিহার্য অংশ- ইউক্রেন।
রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের বিচ্ছেদ, বা স্বাধীন থাকাকে দুগিন কোনোদিন মেনে নেননি। এই স্বাধীনতা দিনশেষে সমগ্র ইউরেশিয়ার জন্য "মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে" বলে সতর্ক করেন তিনি।
বলাবাহুল্য, তার এসব ভাবনা সাম্প্রতিক সময়ে ভ্লাদিমির পুতিনের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। এতেই স্পষ্ট হয় সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
ইউক্রেন নিয়ে দুগিন শুধু চিন্তার জগতেই সীমাবদ্ধ নন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের মাধ্যমে ইউক্রেন-রাশিয়া সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এসময় ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষি অধ্যুষিত ডনবাস অঞ্চলে শুরু হয় কিয়েভ থেকে স্বাধীনতা লাভের লড়াই। এতে রাশিয়া সমর্থন দেয়।
ডনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়তে দুগিন সামরিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রুশ নাগরিকদের উৎসাহিত করছেন—এমন অভিযোগে ২০১৫ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞাও দেয় মার্কিন সরকার।
দুগিন মনে করেন, রাশিয়াকে নিয়ে ভেতরে-বাইরে চক্রান্ত করছে ইহুদিবাদী শক্তিগুলো। ইহুদিবাদের এ বিরোধিতা আর পারতপক্ষে ঘৃণা করাকে বলা হয় অ্যান্টি-সেমিটিজম। রাশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই শাসকশ্রেণি 'অ্যান্টি-সেমিটিক' বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করে আসছে। আবার, যারা ক্ষমতায় নিজেরাই যেতে চায় তারাও করেছে একাজ।
যেমন 'দ্য পিপলস উইল' নামের একটি বামপন্থী সংগঠন রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেক্সান্ডারকে 'ইহুদি জার' হিসেবে প্রচার করে। জারও কম ছিলেন না। তিনি সংস্কারের চাপের মুখে একই কৌশল বেঁছে নেন। তার গুপ্তপুলিশ বাহিনী জাল কিছু নথিপত্র হাজির করে দাবি করে, 'এলডারস অব জায়ন' নামক ইহুদিদের একটি বৈশ্বিক আধিপত্যকামী জোট জার-বিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছে।
বলশেভিক বিপ্লবের পর রাজতন্ত্রপন্থী শ্বেতবাহিনীর (হোয়াইট আর্মি) প্রতিবিপ্লবী শক্তি "ইহুদিদের মেরে রাশিয়াকে রক্ষার" আহ্বান জানায়। অন্যদিকে, বলেশেভিক পার্টির সমর্থকরা শ্বেতবাহিনীকে 'ইহুদি পুঁজিবাদের' সমর্থক বলে দাবি করতে থাকে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা- কেজিবি ইহুদিবিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়েছে। জিউইশ ক্রনিকল দাবি করছে, কেজিবি এজেন্ট থাকার সময় এসব কৌশল ভালোই রপ্ত করেন পুতিন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনকে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদের বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখেন। দুগিনের ভাবাদর্শে তিনি নিজ চিন্তারই প্রতিফলন খুঁজে পান।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একজন ইহুদি। দেশটিতে উল্লেখযোগ্য ইহুদি জনসংখ্যাও রয়েছে। ইউক্রেনের সরকারের ক্রমে পশ্চিমামুখী নীতিকে তাই পুতিন ও তার সহযোগীরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের উর্বর ভূমি হিসেবে দেখতে থাকেন। তার সঙ্গে, দুগিনের সতর্কবার্তা তো ছিলই।
দিনশেষে, দুগিনের দর্শনই কী আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের রাজনৈতিক রসদ যুগিয়েছে?- এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে। পুরোপুরি না হলেও, সক্রিয় রাজনীতিক ও দার্শনিক হিসেবে দুগিন যে তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন- তা অস্বীকার করা যায় না। তাই হয়তো- কেউ কেউ তাকে আধুনিক যুগের রাসপুতিন বলতেও দ্বিধা করেন না।
- সূত্র: জিউইশ ক্রনিকল, দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট অস্ট্রেলিয়া