বায়ুদূষণের শীর্ষে দেশ, বাড়ছে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ
দেশে বায়ুদূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিশুসহ সব বয়সী মানুষের অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন ধরণের শ্বাসতন্ত্রের রোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি মাসের ২২ দিনে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিয়ে ভর্তি হয়েছে ৫০৬৪ জন ও মারা গেছেন ৪ জন। বায়ুদূষণের জন্য শ্বাসতন্ত্রের রোগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
গত রোববার রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় মিরপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের (৪০)। পরদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তার অ্যাজমা শনাক্ত হয়। এখন নিয়মিত দুই বেলা ওষুধ ও ইনহেলার নিতে হচ্ছে তাকে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে থেকে আমার অ্যাজমার কিছু লক্ষণ ছিল কিন্তু এতো বেশি শ্বাসকষ্ট হয়নি। এখন ঢাকা শহরের প্রায় সব রাস্তার কাজ চলছে, প্রচুর ধুলা। দুটা মাস্ক পরেও ধুলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে।
সুইজারল্যান্ডের বায়ুদূষণ এবং বায়ু পরিশোধন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সংস্থা আইকিউএয়ারের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের বাতাসের মান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে,বাতাসের মধ্যে উপস্থিত পার্টিকল বা সূক্ষ্ম কণা পিএম-২.৫ এর গড় বার্ষিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে পিএম-২.৫ এর গড় মাত্রা ছিল ৭৬.৯ মাইক্রোগ্রাম।
চিকিৎসকেরা বলেন, পিএম-২.৫ অতিসূক্ষ্ম হওয়ায় সহজেই মানুষের শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে পড়ছে, পরবর্তী সময়ে যা পুরো শরীরকে আক্রান্ত করছে। এ থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে এ বস্তুকণা মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধি সৃষ্টি করছে। দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ বিভিন্ন রোগ বাড়ছে।
বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তার নির্দিষ্ট কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে ডাক্তারেরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ক্রমশ বাড়ছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের অ্যাজমা সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, শ্বাসতন্ত্রের রোগের সঙ্গে ধুলাবালির সরাসরি সম্পর্ক আছে। ধুলাবালির কারণে অ্যাজমা রোগীদের কষ্ট বেড়ে যায়। শিশুদের ব্রংকিউলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, যক্ষা এসব রোগ ধুলাবালির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই বায়ু দূষণ কমানোর বিকল্প নেই।
ডা. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, কোভিডের সংক্রমণ কমায় এখন আবার আমাদের অ্যাজমা সেন্টারে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ডাস্ট অ্যালার্জি ও অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন দিনে ২৫০-৩০০ রোগী আসছে, কোভিডের আগে এ সংখ্যা ২০০ এর কম ছিল।
ডাক্তাররা বলছেন, বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা, প্রতিবন্ধকতা এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্তের এবং মৃত্যুর হার অনেকাংশে বেড়েছে।
২০২১ সালে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল আউটডোর ও ইমার্জেন্সি মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে। সাত বছর আগে ২০১৬ সালে হাসপাতালটির আউটডোর ও ইমার্জেন্সি মিলিয়ে সেবা নেয় ৮৫ হাজার রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার এবং কন্ট্রোল রুমের ডাটা অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের মার্চ- এই পাঁচ মাসে দেশে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭০,৪১৬ জন ও মারা গেছে ২ জন। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৫২,৪৭৮ জন ও মারা গেছে ৬১ জন।
চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মির্জা মোহাম্মদ হিরন বলেছেন, বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, এর মধ্যে শুধু অ্যাজমাতে আক্রান্ত ৭০ লাখ মানুষ। বায়ু দূষণের কারণে প্রথমে আক্রান্ত হয় ফুসফুস ও শ্বাসনালী। অব্যাহত বায়ু দূষণে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া, সিওপিডি ও ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরণের রোগ বাড়ছে। পরিবেশ দূষণ আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর এক নতুন চ্যালেঞ্জ।