যমুনার চরে যেন মরিচের জমিন
ভালো ফলন ও দাম বেশি পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের যমুনাসহ বিভিন্ন নদীর চরে বেড়েছে মরিচ চাষ। গত কয়েক বছর ধরে দেশীয় মসলা উৎপাদনকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওই অঞ্চল থেকে মরিচ সংগ্রহ করায় এরই মধ্যে সেখানে স্থায়ী বাজারের সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় অনেক চরের মানুষই কম দামে মরিচ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
প্রতি বছর নদী ভাঙনের কারণে কৃষকরা যেমন ক্ষতির সন্মুক্ষীণ হন, তেমনি ওই যমুনাই কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বয়ে আনে পলি মাটি। ওই পলি মাটিতে মরিচ চাষ করলে সার কীটনাশকের খরচ নেই বললেই চলে।
যমুনা ও অন্যান্য নদ-নদীর চরাঞ্চলে উৎপাদিত মরিচ কিনছে স্কয়ার, এসিআই ও প্রাণসহ বিভিন্ন দেশীয় মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বাজারে চাহিদা বাড়তে থাকায় একদিকে বাড়ছে মরিচ চাষের এলাকা, অন্যদিকে ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষিরা। এ বছরও মরিচ চাষ হয়েছে গত বছরের তুলনায় বেশি, কৃষকরা দামও পাচ্ছেন ভালো।
স্কয়ারসহ বিভিন্ন মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে গত কয়েক বছর ধরে মরিচ দিচ্ছেন সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটফুল বাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী সাহাজ্জাত করিম। গত মৌসুমে তিনি বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রায় ৪০০ টন শুকনা মরিচ দিয়েছিলেন; এবার দিতে চান আরও বেশি। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় তা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি।
তিনি বলেন, গত বছর যে মানের শুকনা মরিচ কিনেছি ছয় হাজার টাকায়; সেই মরিচ এবার কিনছি আট হাজার টাকায়। মৌসুম শেষে দাম আরও বাড়বে।
মরিচ প্রধানত তিন স্তরে বিক্রি হয়ে থাকে। কাঁচা, পাকা (লাল মরিচ) ও শুকনা। গত বছর বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চাষিরা বিভিন্ন মসলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ১০ হাজার টন মরিচ বিক্রি করেছেন।
স্থানীয় সারিয়াকান্দি উপজেলার হিন্দুকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর তিনি ২২ শতাংশ জমির পাকা মরিচ বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৩৩ হাজার টাকা। কিন্তু এ বছর পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তিনি মসলা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে মরিচ দেওয়ার জন্য দুই হাজার টাকা দরে কিনেছেন প্রায় ২৫০ মণ পাকা মরিচ।
সারিয়াকান্দি উপজেলার পাকুরিয়া চরের বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন। গত বছর তিনি তিন বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করলেও এবার লাগিয়েছেন দুই বিঘায়। কিন্তু গত বছর তিন বিঘায় ৯০ মণ মরিচ পেলেও এবার দুই বিঘাতেই পেয়েছেন ৮০ মণ কাঁচা মরিচ। দামও পেয়েছেন ভালো।
তিনি বলেন, গত বছর কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ টাকায়। কিন্তু এবার বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। তবে চাষিদের দাবি, মৌসুমের শুরুতে মরিচ আমদানি বন্ধ রাখা হলে মরিচে আরও লাভ পেতেন তারা।
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় মরিচ উৎপাদনকারি এলাকা সারিয়াকান্দিতে গত বছর মরিচ চাষ হয়েছিল প্রায় ২৯ হাজার বিঘায়। এবার হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার বিঘায়। অর্থাৎ এক বছরে এ ফসলের চাষ বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে ছিল জানিয়ে সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল হালিম বলেন, এ বছর প্রতি বিঘায় মরিচের ফলন বেড়েছে গড়ে সাত মণ। এছাড়া চাষিরা ভালো দামও পেয়েছেন।
"মাঠ পর্যায়ের যে তথ্য আমরা পেয়েছি তাতে গত বছরের তুলনায় প্রতি কেজি কাচাঁ মরিচের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত।"
বগুড়া কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক আ ক ম শাহরিয়ার জানান, উত্তরাঞ্চলের চার জেলা পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাটে গত বছর মরিচ চাষ হয়েছিল ৭১ হাজার বিঘায়। আর এবার সেখানে হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০০ বিঘারও বেশি জমিতে।
পাকুরিয়া চরের বাসিন্দা মোসলেম উদ্দিন বলেন, মরিচ উৎপাদনের পর পার্শ্ববর্তী হাটে নিয়ে বিক্রি করতে দুর্ভোগের শেষ নেই। সড়কের বেহাল দশার কারণে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এতে সময় ও অর্থ দুই-ই বেশি খরচ হয়।
চরাঞ্চলের সড়কের বেহাল দশা নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী সাইফুল কবীর বলেন, যমুনা নদীর গতিপথ সব সময় পরিবর্তনশীল। ফলে নদীর পাশ ঘেষা সড়কগুলো প্রায়ই নদী ভাঙনের শিকার হয়। ফলে চরাঞ্চলের সড়ক নির্মাণে সরকারের পক্ষ থেকে আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সারিয়াকান্দি, সোনাতোলা ও ধুনট এলাকার কিছু বৃহৎ চরে সড়ক নির্মাণের চিন্তা রয়েছে।