কেএসআরএম: জাহাজভাঙা শিল্প থেকে সমুদ্রগামী জাহাজের বৃহত্তম বহরের মালিক
প্রায় চার দশক আগে শিপব্রেকিংয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে কেএসআরএম এখন দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত প্রস্তুতকারক ও সমুদ্রগামী জাহাজের বৃহত্তম বহরের মালিক হয়ে উঠেছে। এখন ২৩টি সমুদ্রগামী বাল্ক ক্যারিয়ারের মালিক কেএসআরএম গ্রুপ।
তরুণ বয়সে কেএসআরএম প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ শাহজাহান। এরপর তার দুই ছেলে সারোয়ার জাহান রোকন ও শাহরিয়ার জাহান রাহাত প্রতিষ্ঠানটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তাদের শিল্পের উত্থানের যাত্রা সম্পর্কে কথা বলেছেন।
কেএসআরএম-এর শুরু
আমার দাদা কবির আহমেদ চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকায় একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড কেনার পরপরই ১৯৮৩ সালের ১৩ এপ্রিল মারা যান। বড় ছেলে হিসেবে আমার বাবা মোহাম্মদ শাহজাহানকে দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। যদিও তিনি তখন কলেজে পড়াশোনা করছিলেন, ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। একের পর এক ব্যাংক যখন তাকে ঋণ দিতে রাজি হয়নি, তখন থেকেই তার সংগ্রামের শুরু। কারণ একজন যুবক হিসেবে বাবার প্রমাণপত্রগুলো ঋণের জন্য যোগ্য ছিল না।
কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি, প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। অবশেষে ১৯৯১ সালে একটি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির জন্য অর্থায়ন পরিচালনা করেন।
কিন্তু খারাপ সময় বাবাকে ছাড়ছিল না। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় হয়, যাতে বাংলাদেশের প্রায় ২ লাখ উপকূলীয় মানুষ মারা যান। বাবার জাহাজটিও বঙ্গোপসাগরে ভেসে গিয়েছিল। কয়েকদিন পর তার নিখোঁজ জাহাজের সন্ধান মেলে। তারপর থেকে আমরা আর পিছু ফিরে তাকাইনি।
আমরা একটি ছোট ইস্পাত মিল স্থাপন করেছিলাম, যা ধীরে ধীরে এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ মিলে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন বছরে ৭,০০,০০০ টন রড উৎপাদন করি। মাত্র ৫০-৬০ জন শ্রমিক নিয়ে শুরু হওয়া কারখানাটিতে এখন প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক রয়েছে।
১৯৯৯ সালে আমরা রয়্যাল সিমেন্ট ব্র্যান্ড নামে অংশীদারিত্বে সিমেন্ট ব্যবসায় প্রবেশ করি।
জাহাজ ব্যবসা
জাহাজ ভাঙার ব্যবসার সময় থেকেই আমার বাবা একটি জাহাজের মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর শিপিং ব্যবসার উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখে তিনি একের পর এক জাহাজ কিনতে থাকেন। ২০০৩ সালে তিনি প্রথম এফ জাহান (ফাতেমা জাহান) নামে একটি জাহাজ কিনেছিলেন।
আমাদের এখন ২৩টি সমুদ্রগামী জাহাজ আছে। আমাদের ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদও রয়েছে। কবির অক্সিজেন লিমিটেড, কেএসআরএম পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং কবির শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজের মতো আমাদের ১২টি সিস্টার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
মহামারি মোকাবেলা
মহামারি চলাকালীন ৬-৭ মাসের ইনভেন্টরি পাওয়ার সৌভাগ্য হওয়ায় আমরা উত্পাদন চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমাদের পাঁচ-ছয়টি জাহাজ মাসের পর মাস অলস বসে থাকায় এবং সেই কঠিন সময়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল না থাকায় আমরা জাহাজ শিল্পে চ্যালেঞ্জে পড়ে যাই।
মহামারিজনিত শাটডাউন এবং মালবাহী জাহাজের খরচ বেড়ে যাওয়ার পরে যখন শিপিং আবার চলাচল শুরু করে তখন আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম।
মহামারিতে আমরা কর্মীদের বেতন কমাইনি, বরং সময়মতো তাদের বোনাস দিয়েছি। তাদের পাশে দাঁড়াতে আমরা অনেক ব্যবস্থাও নিয়েছিলাম।
আমাদের শিপিং ব্যবসা বর্তমানে ভালো সাফল্য পেয়েছে। গত বছর আমাদের টার্নওভার আগের ১০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। আমরা ভালো মুনাফা করেছি, কারণ মহামারি-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরায় চালু হওয়ায় আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ইস্পাত পণ্য ও কাঁচামালের স্টক ছিল। ওই সময় সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যায়।
ইস্পাত শিল্পের ভবিষ্যত উজ্জ্বল, কিন্তু বাজার স্যাচুরেশনের শঙ্কা
নিঃসন্দেহে ইস্পাত শিল্প, যা এখন বছরে ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরও বেশি নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ভালোভাবে বিকশিত হতে থাকবে।
কিন্তু যেভাবে বিনিয়োগ আসছে, তাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বাজারে স্যাচুরেশন তৈরি হতে পারে। যেমন আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৯০ লাখ টন আর চাহিদা ৭৫ লাখ টন। এ কারণে আমাদের কারখানাগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চলছে না। তার উপরে অনেক বড় কোম্পানি নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছে। আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে
ইস্পাত শিল্প প্রধানত পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের সম্মুখীন, যা এর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। পানি, জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে এ শিল্প।
এলএনজি সরবরাহের মাধ্যমে গ্যাস সংকট কিছুটা লাঘব হয়েছে। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পানির অভাব। ইস্পাত শিল্পে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা না হলে যেকোনো সময় উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
লোড সীমাবদ্ধতার কারণে সড়কপথে পণ্য পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে। রাস্তার ধারণক্ষমতা গাড়ির ধারণক্ষমতার সাথে মেলে না। এ কারণে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য পরিবহনের জন্য আমাদের আরও যানবাহনের প্রয়োজন হয়। তাই ভাড়ার পাশাপাশি জ্বালানি খরচও বেড়ে যায়।
বন্দরের অপর্যাপ্ত সক্ষমতাও এই শিল্পে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। আমদানির পর কাঁচামাল আনলোড করতে যথেষ্ট সময় লাগে। এতে একজন আমদানিকারকের লাখ লাখ ডলার খরচ হয়, যা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এড়ানো যায়।
নীতিমালা ইস্পাত ব্যবসার পক্ষে নয়
ইস্পাত শিল্পের ওপর ভারী করের বোঝা রয়েছে। কাঁচামাল আমদানির সময় আমাদের উচ্চ কর দিতে হয়। উচ্চ করের হার সবাইকে প্রভাবিত করে। সরকারী প্রকল্পগুলো আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে এবং গ্রাহকদের খুব বেশি ক্রয়ক্ষমতা নেই। তাই তাদের জন্য ট্যাক্স লাঘব খুবই জরুরি।
দেশের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও, একটি নির্দিষ্ট শিল্পের উপর এই ধরনের বোঝা যথাযথ নয়। এছাড়াও আমাদের সড়কগুলো আন্তর্জাতিক মানের নয়। তাই আমরা পূর্ণ ক্ষমতায় যানবাহনে পণ্য লোড করতে পারি না। ফলে প্রতি মেট্রিক টন ডেলিভারি খরচ বাড়ছে।