‘বিমানে ভ্রমণ যেন অভিশাপ,’ গণশুনানিতে যাত্রীরা
নিয়মিত ফ্লাইট বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রীরা জাতীয় এয়ারলাইন্সে ভ্রমণকে 'অভিশাপ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
কুমিল্লার বাসিন্দা মো. রিয়াদ সরকার মঙ্গলবার বেলা ১১টায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর কথা ছিল। এজন্য তিনি কয়েক ঘণ্টা আগেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। কিন্তু কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর জানতে পারেন ফ্লাইট ডিলে হবে; নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১৬ ঘন্টা পর রাত তিনটায় ছাড়বে ফ্লাইট। এ বিষয়ে জানতে বিমানবন্দরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সংশ্লিষ্ট শাখায় গিয়েও অসদাচরণের মুখোমুখি হন তিনি।
"বিমান যেন একটা অভিশাপ। কেননা আমি যতবারই সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে আসছি, ততবারই ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। যেমন আজকেও ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। বেলা ১১টার ফ্লাইট এখন যাবে রাত তিনটায়।" মঙ্গলবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যাত্রী সেবার মান উন্নত করার লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) আয়োজিত গণশুনানীতে নিজের ভোগান্তির কথা এভাবেই তুলে ধরেন রিয়াদ।
তিনি বলেন, "আমি যখন দেরি হওয়ার কারণ জানতে বিমানের টিকিট কাউন্টারে গিয়েছি, তারা আমার সাথে অসদাচরণ করেছে।"
বিমানের সেবার মান নিয়ে এমন অভিযোগ শুধু রিয়াদের নয়। আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে নানান হয়রানির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই করে আসছেন যাত্রীরা।
৩৩ বছর ধরে জেদ্দা থাকেন লক্ষীপুরের গোলাম মোস্তফা । বিমানের ফ্লাইট ডিলে ও লাগেজ পেতে বিড়ম্বনার চিত্র তুলে ধরে তিনি গণশুনানীতে বলেন, "একবার দু'বার ডিলে হতে পারে। কিন্তু বারবার ডিলে হলে যে কী পরিমাণ ভোগান্তি হয়, তা না দেখলে বোঝা দায়! একইভাবে লাগেজ পেতেও দুই ঘন্টা বিলম্ব হয়। এর কারণটা কী? অন্য এয়ারলাইন্সে তো হচ্ছে না।"
এ অভিযোগ শুনে গণশুনানি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএবি) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বিমানের প্রতিনিধি হিসেবে কে গণশুনানিতে উপস্থিত আছেন জানতে চান। গণশুনানিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইনসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও বিমানের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত ছিল না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিএএবি'র চেয়ারম্যান।
পরে বিমানের স্টেশন ম্যানেজার আরিফুজ্জামান খান উপস্থিত হয়ে যাত্রীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, "আমি বিমানের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, যে লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। যাত্রিরা আমাদের কাছে ভিআইপি। তাদের পয়সা দিয়ে আমাদের বেতন হয়।"
যাত্রীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, "আপনার (রিয়াদ) সঙ্গে এমন ঘটনার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। বিলম্বের বিষয়টি বিমান আপনাকে জানায়নি। এটা বিমান ঠিক করেনি। এটার জন্য এয়ারলাইন্সকে তলব করবো আমরা।"
সৌদিগামী রিয়াদ সরকার বলেন, "শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আমার কাছে মনে হয় টু্যরিস্ট এলাকা। বাইরে যে পরিমাণ মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে মনে হয় এটা সমুদ্র সৈকতের মতো কোনো ট্যুরিস্ট এলাকা। মানুষের ঠেলায় বিদেশগামীরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন না। এটা তো কোনো সিনেমা হল নয়।"
তিনি বলেন, "আমাদের কুমিল্লায় একটা এয়ারপোর্ট আছে। কিন্তু সেটা চালু নেই। অথচ এখানে মানুষকে জিম্মি করা হয়। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দের যে সেবা পাওয়ার কথা ছিল সেটা আমরা পাচ্ছি না।"
যাত্রীর সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিষয়ে মফিদুর রহমান বলেন, "বেশিরভাগ সময় যাত্রীর সঙ্গে পুরো পরিবার বিমানবন্দরে চলে আসে। এসব বিষয়ে যাত্রীদেরই সচেতন হতে হবে।"
যাত্রী সেবা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে দাবি করে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, "আমাদের প্রতিটা প্যাসেঞ্জারকে আমরা সম্মান করি। আমরা চেষ্টা করছি বিজনেস ক্লাস হোক, ইকোনোমি ক্লাস হোক, সব প্যাসেঞ্জারকে একইরকম সেবা দিতে।"
তিনি বিমানবন্দরের হেল্প ডেস্ক, ম্যাজিস্ট্রেট অথবা এয়ারলাইন্সের কাছে অভিযোগ করতে বলেন।
লাগেজের বিষয়ে তিনি বলেন, "এখন ফার্স্ট লাগেজ আসে ২০ মিনিটে। লাস্ট লাগেজে এক থেকে দেড় ঘন্টার বেশি সময় লাগে না। যদি কোনো এয়ারলাইন্স দেরি করে তার জন্য শোকজ করি। আমার জানামতে এখন কোনো লাগেজ ডিলে হয় না।"
টিকিটের উচ্চমূল্য নিয়েও অভিযোগ আসে শুনানীতে।
এক যাত্রী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "আমি আবুধাবি থেকে এসেছি ইতিহাদ এয়ারলাইন্সে, মাত্র ৫০ হাজার টাকা টিকিটের দাম। কিন্তু যাওয়ার সময় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ, দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত টিকিটের দাম। এমনটি কেন?"
তিনি আরও বলেন, "গত ২ বছর আগে বিদেশ থেকে শাহজালাল এয়ারপোর্ট আসার পর আমার লাগেজ থেকে মোবাইল চুরি হয়ে যায়। এ ব্যাপারে অথরিটিকে বলার পর তারা আমাকে পরে আসতে বলেন। একটা ২০ হাজার টাকার মোবাইলের জন্য কুমিল্লা থেকে এখানে আসা সম্ভব না। পরে আমি আর সে মোবাইল পাইনি।"
এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, "বর্তমানে যে ব্যবস্থাপনা করেছি লাগেজে কেউ হাত দেওয়ার সাহস পাবে না। আপনার উচিত ছিল অভিযোগের ফলোআপ করা।"
তিনি আরও বলেন, টিকিটের দাম কমানোর জন্য সরকার এয়ারলাইন্সের সঙ্গে বরাবরই কাজ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যাত্রীর তুলনায় ফ্লাইটের সংখ্যা কম। চাহিদা বেশি থাকায় ভাড়া কিছুটা বেড়ে যায়।
গণশুনানিতে অংশ নেন জর্জিয়ার নাগরিক কার্ল অগাস্টন। বাংলাদেশি মুঠোফোন অপারেটরের সিম না থাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে ওয়াইফাই সুবিধা ব্যবহার করতে না পারার বিষয়ে অভিযোগ জানান তিনি।
এর জবাবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান বলেন, "বিমানবন্দরের আগমনী টার্মিনালে সব যাত্রীর জন্য ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বহির্গমনে ওয়াইফাই নেই।"
তবে দ্রুত এ ব্যবস্থা রাখার আশ্বাস দেন তিনি।