২০৩৪ সালের মধ্যে ২৬টি নতুন বিমান কেনার পরিকল্পনা বিমান বাংলাদেশের
আন্তর্জাতিক বিমান ভ্রমণ এবং বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আগামী ২০৩৪ সালের মধ্যে নতুন অন্তত ২৬টি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছে।
সম্প্রতি বিমানের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত নতুন এক পরিকল্পনা অনুসারে, নতুন ক্রয়ের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশের ফ্লিট ২১ থেকে ৪৭ এ উন্নীত হবে। অর্থাৎ, ২০৩৪ সাল নাগাদ বিমানের ফ্লিট ১২২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বহরে ৩০০ আসন বিশিষ্ট কমপক্ষে ৮টি, ২৭০ আসন বিশিষ্ট ৬টি, ১৬০ আসন বিশিষ্ট ৬টি, ৭০ আসন বিশিষ্ট ৪টি এবং ৪০০ আসন বিশিষ্ট একটি বিমান যুক্ত হবে বলে জানা গেছে।
এই সম্প্রসারণের ফলে, বিমানের আসন সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি হবে; বর্তমান এর দৈনিক যাত্রী সক্ষমতা ৫,০০০। নতুন সংযোজনের মাধ্যমে এই সক্ষমতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশকে একটি এভিয়েশন হাবে রূপান্তরিত করার সরকারের প্রচেষ্টার সঙ্গে তাল দিয়ে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস নতুন বিমানগুলোর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউইয়র্কসহ নতুন কিছু রুটে ব্যবসা বাড়াতে চায়।
বিমানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) এবং সিইও শফিউল আজিম টিবিএসকে বলেন, "১০ বছর মেয়াদী ফ্লিট এবং রুট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বেশ কয়েক বছর ধরে বিবেচনায় ছিল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৩০০তম বোর্ড সভায় এটি অনুমোদিত হয়। পরিকল্পনাটি যেকোনো সময় আমরা সংশোধন করতে পারবো।"
"আমরা বছরে দুই থেকে তিনটি বিমান বহরে যুক্ত করার পরিকল্পনা করছি। আমাদের রুটগুলো তৈরি আছে, শুধু অপারেশন শুরু করতে হবে," বলেন তিনি।
বিমান সূত্রে জানা যায়, নতুন উড়োজাহাজ কেনার ক্ষেত্রে এয়ারবাস এবং বোয়িং উভয়ের প্রস্তাবই মূল্যায়ন করছে রাষ্ট্রীয় এই বিমান সংস্থা। ফলে বলা যায়, বোয়িংয়ের অধিপত্য কমে গিয়ে শীঘ্রই সংস্থাটির বহরে বৈচিত্র্য আসতে চলেছে।
ইউরোপীয় ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট এয়ারবাসের প্রস্তাবের পর বিমান বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে এয়ারবাস থেকে দুটি কার্গো মালবাহী বিমানসহ ১০টি এয়ারবাস এ৩৫০ ওয়াইডবডি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ক্রয় প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য গত ৫ মার্চ একটি টেকনো-ফাইনান্সিয়াল কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে, এয়ারবাসের প্রস্তাবের পর প্রতিদ্বন্দ্বী বোয়িংও রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাটির কাছে তাদের নতুন প্রস্তাব জানিয়েছে।
শফিউল আজিম বলেন, "সবচেয়ে বড় কথা এয়ারক্রাফট কেনার জন্য নগদ কোনো টাকা দিতে হচ্ছে না। এর আগে, আমরা যেসব এয়ারক্রাফট কিনেছি সেগুলোর কিস্তি নিয়মিত দিয়েছি। নতুন করে কিনলেও সেরকমই হবে।"
যে মার্কেট বাংলাদেশে আছে, তা কাভার করতে চাইলে নতুন এয়ারক্রাফট কেনার কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, "আমরা বসে থাকলেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেমন– ইন্ডিয়া, থাইলান্ড, ভিয়েতনাম তারা শতাধিক করে এয়ারক্রাফট যোগ করছে। এবং আমাদের মার্কেটও তাদের টার্গেটের মধ্যে আছে।"
বর্তমানে, বিমান বাংলাদেশসহ স্থানীয় এয়ারলাইন্সগুলো দেশের এভিয়েশন খাত ব্যবসায়ের মাত্র ২০-২৫ শতাংশের ভাগিদার, বাকি অংশে বিদেশি সংস্থার আধিপত্য বেশি।
আন্তর্জাতিক যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিমান বাংলাদেশ অন্যান্য বেশ কয়েকটি স্থানীয় এয়ারলাইনের সঙ্গে মিলে বিদেশি প্রতিযোগীদের মুখোমুখি হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মতে, গত বছর রেকর্ড ১৭.৪ মিলিয়ন যাত্রী দেশের বিমানবন্দরগুলোকে ব্যবহার করেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারী। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৩.৪ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশি ও বিদেশি উভয় প্রকার যাত্রী মিলিয়ে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক যাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২.৬৭ মিলিয়ন বেড়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ এবং কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় ৩৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয়।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক শ্রম রপ্তানি, শিক্ষাগত অভিবাসন, বিদেশে চিকিৎসা ও পর্যটন এবং ব্যবসায়িক ভ্রমণের কারণে দেশের আন্তর্জাতিক যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা বিমানবন্দরে নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালসহ বিমানবন্দরের উন্নয়নে ৩২,০০০ কোটি টাকার বড় বিনিয়োগ বিমান বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক সুযোগ তৈরি করছে।
অবকাঠামোগত এই উন্নয়ন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং এমনকি ইউরোপজুড়ে বিমানের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
নতুন রুটে বিমান
বর্তমানে তিন মহাদেশ, উত্তর আমেরিকা,ইউরোপ এবং এশিয়ার ২২টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বলেন, "ঢাকা থেকে ভিয়েতনাম/কোরিয়া হয়ে জাপানের টোকিওর পূর্বের শহর নারিতা পর্যন্ত একটি নতুন রুট হতে পারে। আবার এদিকে, ঢাকা-ইন্দোনেশিয়া-সিডনি হবে নতুন রুট। আর নিউইয়র্কের জন্য প্রস্তুতি চলছে।"
"ভবিষ্যতে মালে, সিডনি, কুনমিং, ইয়াঙ্গুন, নিউইয়র্ক যোগ হবে। আর বাহরাইনের সাথে আমরা কোড শেয়ারিংয়ে যাচ্ছি," যোগ করেন তিনি।
কোড শেয়ারিং হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একটি এয়ারলাইন অন্য আরেকটি এয়ারলাইন দ্বারা পরিচালিত ফ্লাইটে তার মনোনীত কোড স্থাপন করে এবং সেই ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি করে।
গত দুই বছরে বিমান বাংলাদেশ কানাডার টরন্টো, জাপানের নারিতা এবং চীনের গুয়াংজুতে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। ইতালির রোমে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়েছে গত ২৭ মার্চ।
এয়ারবাস উড়োজাহাজের খরচ
১০০-১৫০ আসনের ২-৩টি ইকোনমি কনফিগারেশন বিশিষ্ট এয়ারবাস এ২২০ বিমানটির ২টি ধরন রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে দামও দুইরকম।
আন্তর্জাতিক এভিয়েশন নিউজ পোর্টাল সিম্পল ফ্লাইংয়ের তথ্যমতে, ছোট এ২২০-১০০-এর দাম প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার; অন্যদিকে, বড় এবং বেশি চাহিদাসম্পন্ন এ২২০-৩০০-এর দাম ৯১.৫ মিলিয়ন ডলার।
এয়ারবাস এ৩২০ পরিবারের বিমানগুলো স্বল্প থেকে মাঝারি দূরত্বের ফ্লাইটের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী; এগুলো ১০০ থেকে ২৪০ জন যাত্রী বহন করতে পারে। বাজারে বোয়িং ৭৩৭ সিরিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এই বিমান ডিজাইন করেছে এয়ারবাস।
এই সিরিজের এ৩২০সিইও বিমানটির দাম ১০১ মিলিয়ন ডলার, যেখানে এ৩২০এনইও-এর দাম ১১০.৬ মিলিয়ন ডলার।
এয়ারবাস এ৩২০ সিরিজের সবচেয়ে ছোট এবং দুর্লভ বিমানটি হলো এ৩১৮। এই সিরিজের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সস্তা বিমান। 'বেবি বাস' নামে পরিচিত বিমানটির মূল্য ৭৭.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিমানের এমডি বলেন, "কেউ নগদ টাকা দিয়ে এয়ারক্রাফট কেনে না। আমরা যে বোয়িং থেকে কিনেছি, সেগুলোর কিস্তি নিয়মিতই দিচ্ছি।"
"যেকোনো একটি ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নটা হয়। তবে এটি ঋণ না। ব্যাংকের সাথে এবং ওই কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তির ভিত্তিতেই এয়ারক্রাফট কেনা হয়," যোগ করেন তিনি।
বিমানের আর্থিক সক্ষমতা সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই জানিয়ে শফিউল আজিম বলেন, "এতিদন আমরা আমাদের এক্সিসটিং এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য যে ইন্সটলমেন্ট আসছে, তা পরিশোধ করে আসছি। ইতোমধ্যে গত বছর দুটির ইন্সটলমেন্ট সম্পূর্ণ পরিশোধ হয়ে গেছে।"