বছরে ৪.৮ মিলিয়ন কম্প্রেসার তৈরি করতে ৩টি ইতালীয় ব্র্যান্ড কিনল ওয়ালটন
২০০৮ সালে বিখ্যাত ইতালীয় ব্র্যান্ড এসিসি থেকে কম্প্রেসার আমদানি করে দেশে রেফ্রিজারেটর এবং ফ্রিজার উৎপাদন শুরু করে ওয়ালটন। এখন বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট নিজেই কম্প্রেসার ব্র্যান্ডটি কিনেছে।
এক দশকেরও বেশি সময়ের পথচলায় ওয়ালটন দেশের ফ্রিজ বাজারে শীর্ষস্থান দখল করেছে। ২০১৭ সালে তাদের প্রথম কম্প্রেসার উৎপাদন কারখানা স্থাপনের পর থেকে কোম্পানিটি আমেরিকা, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রেফ্রিজারেটর রপ্তানি করে আসছে।
৫০ বছরেরও বেশি ঐতিহ্যের এসিসি কম্প্রেসার ব্র্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে, ওয়ালটন এখন ইউরোপসহ ৫৭টি দেশের বাজারে বড় পদার্পণের পথে।
শুক্রবার ইতালির মেল শহরে সই হওয়া বিক্রয় চুক্তি অনুসারে, এসিসিতে ৫০ বছর ধরে নির্মিত কম্প্রেসারের মেশিনারি, ট্রেডমার্ক এবং পেটেন্ট বাংলাদেশের ওয়ালটন গ্রুপের অধিকারে আসছে।
চুক্তির শর্তানুসারে এসিসির প্রায় ত্রিশজন কর্মী এখন থেকে চলতি বছর শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত ইতালির কারখানা থেকে যন্ত্রপাতি বিচ্ছিন্নকরণ এবং তা বাংলাদেশে আনার পর সংযোজনের কাজ করবে। বাংলাদেশে প্রথম স্থাপিত উৎপাদন লাইনের কর্মীদের সাথেও তারা কাজ করবে বলে অনলাইন নিউজ আউটলেট- ব্রেকিং লেটেস্ট নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বুধবার (৬ এপ্রিল) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেওয়া মুল্য-সংবেদনশীল তথ্যে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি ইতালিয়া ওয়ানবাও-এসিসি থেকে আরো দুটি ব্র্যান্ড - জানুসি ইলেট্রোমেকানিকা (জেইএম) এবং ভার্ডিক্টার (ভিওই) - কেনার ঘোষণা দিয়েছে।
ওয়ালটন জানিয়েছে, তারা একটি দরপত্র (টেন্ডার) জিতে তিনটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ করতে পেরেছে। কোম্পানিটির রিচালনা পর্ষদও সর্বসম্মতিক্রমে ক্রয়ের পদক্ষেপ অনুমোদন করেছে।
ওয়ালটনের একজন কর্মকর্তা জানান, ইতালিয়া ওয়ানবাও-এসিসি তাদের কম্প্রেসার ইউনিট ওয়ালটনের কাছে উন্মুক্ত দরপত্রে বিক্রি করেছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হবে। গত ৫০ বছর ধরে পরিচালিত ইতালীয় কোম্পানিটি ৫৭টি দেশে ব্যবসা করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ওয়ালটন বার্ষিক ৩২ লাখ ইউনিট উৎপাদন সক্ষমতার একটি ইনভার্টার ও নন-ইনভার্টার কম্প্রেসার লাইন কিনবে। কোম্পানিটি আরো জানিয়েছে, পরবর্তীতে তাদের কম্প্রেসার উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ৪৮ লাখে উন্নীত করবে, যা ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য বাজারে তাদের পণ্যের উল্লেখযোগ্য বাজার অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
বিশ্ববাজারে পরিচালনা কার্যক্রম সচল রাখতে ওয়ালটনের পরিচালক বোর্ড ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সহায়ক কোম্পানি, শাখা অফিস বা লিয়াজোঁ অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দেশীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা বিদেশি ব্র্যান্ড কিনেছে।
যদিও ওয়ালটন, ডিএসইতে জমা দেওয়া তাদের নিয়ন্ত্রক ফাইলিংয়ে তিনটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড কিনতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন তা উল্লেখ করেনি।
কয়েক দশক পুরনো ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর নতুন মালিক হিসেবে ওয়ালটন সেগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এছাড়াও, ওয়ালটন স্থানীয় বাজারে ব্র্যান্ডগুলোর অধীনে পণ্য চালু করতে পারে।
শিগগিরই দেশে তাদের বিদ্যমান কারখানায় এসিসি ব্র্যান্ডের অধীনে কম্প্রেসার এবং রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে যাবে ওয়ালটন। অন্য দুটি ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদনও পর্যায়ক্রমে শুরু হবে বলেও কোম্পানির কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
সূত্রমতে আরও জানা যায়, এ প্রকল্পের জন্য ওয়ালটনের বড় অঙ্কের প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রয়োজন এবং বেশিরভাগ অর্থায়ন আসবে জার্মানি ভিত্তিক ঋণদাতা ডিইজি এবং অস্ট্রিয়ান ঋণদাতা ওইইবি থেকে।
ওয়ালটন হাই-টেকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) আবুল বাশার হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি গ্লোবাল ব্র্যান্ডের মধ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে ওয়ালটনের। এই লক্ষ্য অর্জনে বৈদেশিক সম্পদ অধিগ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তবে তিনি প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতার উল্লেখ করে ক্রয় মূল্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন।
ওয়ালটনের এএমডি আরো জানান, ইতালিয়া ওয়ানবাও-এসিসি ইতালির একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা। কোম্পানিটির স্বত্বাধিকারীরা শুধু টাকার জন্যই নয় বরং ওয়ালটন সম্পর্কে তাদের যে সম্ভ্রম ও আস্থা রয়েছে- সেকারণেই তাদের হাই-টেক কম্প্রেসার ইউনিটটি বিক্রি করেছে।
ইতালির বেলুনোতে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী কোম্পানি হলো এসিসি কম্প্রেসরস। এটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির কম্প্রেসার উৎপাদনে একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, সুনাম এবং একটি ভাল বাজার অংশীদারিত্ব থাকা সত্ত্বেও ইউনিটটি প্রধানত রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কারণে কিছু সমস্যায় ভুগছিল।
২০১৪ সালে এটি অধিগ্রহণ করে চীনের বহুজাতিক 'ওয়ানবাও গ্রুপ কম্প্রেসার কোম্পানি লিমিটেড'। বেলুনোর কারখানাটি সচল রাখতে তারা ইতালি সরকারের সাথে একটি চুক্তি করে এবং সেজন্য বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দেয়।
ইতালির অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় ওয়ালটন গ্রুপকে ওয়ানবাও-এসিসি প্রোডাকশন লাইন বিক্রির আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। কোম্পানিটির বর্তমান টার্নওভার প্রায় ১০০ কোটি ডলার এবং কাজ করছে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী।
এসিসির এক্সট্রা-অর্ডিনারি কমিশনার মাউরিজিও ক্যাস্ট্রো এবং ওয়ালটন গ্রুপের সিইও এবং স্বত্বাধিকারী গোলাম মুর্শেদ বিক্রয় চুক্তিতে সই করেছেন। যার সুবাদে বাংলাদেশি হোম অ্যাপ্লায়েন্স প্রস্তুতকারকটি ৫০ বছরের জন্য নির্মিত কম্প্রেসার ব্র্যান্ডের মেশিনারি, ট্রেডমার্ক এবং পেটেন্ট স্বত্ব অর্জন করেছে।
গেল ১ এপ্রিল বোরগো ভালবেলুনা মিউনিসিপ্যালিটির সদর দফতরে চুক্তি সইয়ের সময়, মরিজিও ক্যাস্ট্রো ওয়ালটনকে 'ভবিষ্যতের স্যামসাং' বলে অভিহিত করেছিলেন বলে ব্রেকিং লেটেস্ট নিউজ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে, ইতালীয় কোম্পানিটি তাদের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে নতুন ক্রেতার কাছে দেনামুক্ত প্ল্যান্ট সরবরাহ করবে।
ক্যাস্ট্রো বলেন, "শ্রমিকদের কাছে আমাদের প্রায় ২০ লাখ ডলার দেনা রয়েছে, ওয়ালটনের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে আমরা প্রয়োজনীয় তহবিল যোগাড় করে তা পরিশোধের সুবিধা পাচ্ছি। এছাড়া, চুক্তিতে শিল্পটির সরবরাহকদের প্রতিও সম্মান দেখানো হয়েছে, ফলে তারাও বঞ্চিত হবে না।"
কীভাবে অধিগ্রহণ করা ব্র্যান্ডগুলোকে পুনর্জীবিত করে তাদের বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে তার প্রতি আলোকপাত করে ওয়ালটনের সিইও বলেছেন, "এভাবে ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি পারিবারিক বন্ধন তৈরি হলো।"
গেল ফেব্রুয়ারির শুরুতে, একটি ইতালীয় কোম্পানি এলইউ-ভিই গ্রুপ, প্রায় ৬০ লাখ ইউরোর মোট বিনিয়োগের পূর্বাভাসসহ ওয়ানবাও- এসিসির ইতালি শাখা কেনার প্রস্তাব দেয়।
তবে সম্ভাব্য ক্রেতা পুরানো উৎপাদন লাইনগুলি ভেঙে দিত একারণে কর্মচারীরা ওই চুক্তিকে সমর্থন করেনি বলে ব্যাখ্যা করেছেন ক্যাস্ট্রো।
ইউরোপে, প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ রেফ্রিজারেটর তৈরি করা হয়। প্রধান উৎপাদনকারী দেশ হল- তুরস্ক ও রাশিয়া। ১৭ লাখ ইউনিট উৎপাদন করে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ইতালি।
ইউরোপীয় কম্প্রেসার বাজারের ৭২ শতাংশ চীনের দখলে। গৃহস্থালি রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতে সেখানে বার্ষিক ২ কোটি ৮০ লাখ কম্প্রেসার প্রয়োজন। এরমধ্যে কেবল ১৪ শতাংশ অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলি থেকে আসে। এবং মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ আসে ইউরোপীয় প্রস্তুতকারকদের থেকে। কারণ বেশিরভাগ ইউরোপীয় কোম্পানি কম খরচের কারণে বাইরে থেকে পণ্য সংগ্রহ করতেই পছন্দ করে। এসব তথ্য জানা গেছে ২০২১ সালে করা ওয়ানবাও-এসিসির একটি শিল্প পর্যালোনা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে।
ওয়ালটন বাংলাদেশের প্রথম কোম্পানি, এশিয়ার অষ্টম এবং বিশ্বের ১৫তম কোম্পানি হিসেবে ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল থেকে কম্প্রেসার প্রস্তুত শুরু করে। গাজীপুরের চন্দ্রায় কোম্পানিটি একটি অত্যাধুনিক কম্প্রেসার উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছে। কারখানাটি বর্তমানে এয়ার কন্ডিশনার এবং রেফ্রিজারেটরের জন্য কম্প্রেসার তৈরি করছে।
বর্তমানে, দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্টটি স্থানীয় বৈদ্যুতিক হোম অ্যাপ্লায়েন্স বাজারের ৬০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে। স্থানীয় রেফ্রিজারেটরের বাজারের দুই-তৃতীয়াংশ, টেলিভিশনের প্রায় অর্ধেক এবং এয়ার কন্ডিশনার বাজারের এক-তৃতীয়াংশও তাদের নিয়ন্ত্রণে। দেশের পাশাপাশি বর্তমানে প্রায় ৪০ দেশেও রপ্তানি করছে গৃহস্থালি ইলেকট্রনিক্স পণ্য।
২০২০ সালে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ডিএসইতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ১,০৭৮ টাকায়।