রোগীর জন্য যখন চিকিৎসকের হাতে সময় নেই...এমনকি প্রাইভেট চেম্বারেও
চলতি বছরের ৩০ মার্চ রাত ৭টা ৫৫ মিনিট। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের দোতলায় ডাক্তারের চেম্বারের সামনে অপেক্ষারত রোগীর ভিড়।
সেখানেই মামা ও মাকে কার্ডিয়াক বিশেষজ্ঞ দেখানোর অপেক্ষায় গাজীপুরের রুবেল হোসেন। বিকেল ৫টায় ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল নেয়া থাকলেও রাত আটটায় ডাক্তার দেখাতে পারেন তারা। দুজন রোগীকে একসঙ্গে দশ মিনিট দেখে বিভিন্ন ধরনের টেস্ট দেন ডাক্তার।
কিন্তু তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর দুজন রোগীকে দশ মিনিট সময় দেওয়ায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি রোগী ও স্বজনেরা। রুবেল বলেন, 'ডাক্তার যদি একজন রোগীকে মাত্র ৫ মিনিট দেখেন, তাহলে ১,৫০০ টাকা ফি দিয়ে গাজীপুর থেকে এত কষ্ট করে এসে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম কেন?'
একই দিন রাত নয়টায় গ্রিন রোডের কমফোর্ট টাওয়ারের তিনতলায় এক নিউরোলজি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে দেখা যায় অপেক্ষারত রোগীরা ডাক্তারের সহকারীর কাছে সিরিয়াল এগিয়ে নেয়ার জন্য জটলা পাকাচ্ছেন।
ওই নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ বিকেল ৫টা থেকে রোগী দেখার সময় দিলেও সেদিন তিনি চেম্বারে আসেন সাড়ে ছয়টায়। তাই প্রথমদিকে যাদের সিরিয়াল নেয়া ছিল, তাদেরও দেড় ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়। ওই ডাক্তারের চেম্বারে সেদিন ৬০ জন রোগীর সিরিয়াল নেওয়া ছিলো।
সেখানেই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কথা হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ফাতেমা বেগমের সঙ্গে (৬৫)। মাথা ও ঘাড়ব্যথার জন্য সন্ধ্যা ৭টায় সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন, কিন্তু ডাক্তার তাকে দেখেন সাড়ে ৯টায়। তাকে দেখতে ডাক্তার ৫ মিনিটও সময় নেননি। ওই সময়ে ফাতেমাকে দেখে ঘাড়ের এক্সরে ও কিছু ওষুধ লিখে দেন তিনি। দুদিন পর এক্সরের রিপোর্ট নিয়ে আবার আসতে বলেন তাকে।
সরকারি হাসপাতালে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে ডাক্তারেরা ঠিকমতো রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন না বা সময় দিতে পারেন না। সে কারণে রুবেল ও ফাতের মতো অনেকেই বেশি টাকা খরচ করে প্রাইভেট ডাক্তারদের দেখাতে পছন্দ করেন।
কিন্তু অভিযোগ আছে, প্রাইভেট চেম্বারেও চিকিৎসকেরা রোগীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, প্রশ্নের জবাব দেন না এবং যথেষ্ট সময় দেন না। কখনও কখনও তারা রোগীদের কথা ভালোভাবে না শুনেই প্রেসক্রিপশন দেন। এমনকি প্রেসক্রিপশনও ঠিকমত বুঝিয়ে দেন না বলে অভিযোগ অনেক রোগীর।
গত ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের আউটডোরে যায় টিবিএস। সেখানে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের উপচে পরা ভিড়। মেডিসিন বিভাগের আউটডোরে রোগীর ভিড় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর রোগী যখন ডাক্তার দেখাতে যান, তখন ডাক্তাররা এক-দুই মিনিটের বেশি সময় দেন না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টের একজন চিকিৎসক টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের ডিপার্টমেন্টের আউটডোরে ডাক্তার বসেন মাত্র ৬ জন, আর প্রতিদিন রোগী আসে ৪০০-র বেশি। আমরা চাইলেও রোগীকে দুই মিনিটের বেশি সময় দিতে পারি না। আর এত অল্প সময়ে রোগীর হিস্ট্রি নেওয়ার সুযোগই থাকে না।'
চিকিৎসক সংকট অন্যতম কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কম থাকায় প্রাইভেট চেম্বারেও ডাক্তাররা রোগীদের সময় দিতে পারছেন না। এছাড়া যানজট, একাধিক চেম্বার করাসহ বিভিন্ন কারণে ডাক্তাররা সিরিয়াল দেয়ার নির্দিষ্ট সময়ে রোগী দেখতে পারেন না। পরে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে বাধ্য হয়ে দু-তিন মিনিটে রোগী দেখতে হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, 'বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগী গেলে তারা সব রিপোর্ট দেখবেন, আগে কোনো অপারেশন হলে তা-ও দেখবেন। তা না হলে সেবাগ্রহীতা ও সেবাদাতা কেউ সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকট থাকায় প্রাইভেট চেম্বারে ডাক্তাররা যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না।
'বাংলাদেশে মাত্র ১ হাজার ২০০ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আছেন, ১ হাজার ৩০০-র মতো শিশু বিশেষজ্ঞ, নিউরোসার্জন ২০০ জন, ২৫০ জন বিশেষজ্ঞ মানসিক চিকিৎসক আছেন। কিন্তু জনসংখ্যা ১৭ কোটি।'
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাস্থ্যকর্মী ঘনত্বের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ১০ হাজার রোগীর বিপরীতে ডাক্তার ছিলেন ৬ জন। সিঙ্গাপুরে যা প্রায় ২৫ জন, মালয়শিয়ায় প্রায় ২৩ জন, মালদ্বীপে প্রায় ২১ জন, শ্রীলঙ্কায় ১২ জন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের তথ্যমতে, দেশে এখন প্রায় ১ লাখ নিবন্ধিত ডাক্তার আছেন। তবে তাদের মধ্যে কতজন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, তা জানা যায়নি।
২০১৭ সালে বিএমজে জার্নালে 'ইন্টারন্যাশনাল ভেরিয়েশনস ইন প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান কনসালটেশন টাইম: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ অভ ৬৭ কান্ট্রিজ' শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। ওই সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৫ বাংলাদেশের প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান গড়ে মাত্র ২ মিনিট পরামর্শ দিতে পারতেন।
চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসার জন্য রোগীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আর যাদের বিদেশে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা দেশে যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
ছোট-বড় যেকোনো সমস্যায় পরিবারের সবার চিকিৎসা ভারতে করান যশোরের মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, 'ভারতে ডাক্তাররা সময় নিয়ে সব সমস্যা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন। তাই টাকা খরচ হলেও সন্তুষ্টি আছে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা আন্তরিকতার সাথে রোগীর কথা শোনেন না, তাদের সমস্যা বুঝিয়ে বলেন না। উল্টো দিকে ভারতের চিকিৎসকেরা বেশি আন্তরিকতা নিয়ে রোগী দেখেন।
'ভারতের ডাক্তাররা এই কৌশলটাই রপ্ত করেছে। বাংলাদেশের রোগী গেলে তারা বেশি সময় দেন, আন্তরিকভাবে কথা বলেন। ফলে একজন রোগী যখন দেশে ফিরে তাদের প্রতিবেশী, আত্মীয়দের বলেন, তখন তারাও দেশের বাইরে যান,' বলেন তিনি।
রোগীরা পুরো অধিকার আদায় করতে পারছেন না
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাক্তাররা কী ধরনের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তার বিস্তারিত জানার অধিকার রয়েছে সব রোগীর।
পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অভ বাংলাদেশের উপদেষ্টা অধ্যাপক শারমীন ইয়াসমিন বলেন, 'রোগীকে কী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, সেটার জন্য কেমন খরচ হবে, কী ওষুধ দেয়া হচ্ছে বা হবে, কোনটা করলে ভালো হবে, না করলে কী কী সমস্যা হতে পারে, সেবা পাওয়ার সময় তার যদি কোনোরকম ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে—এসব প্রতিটি তথ্য রোগী বা তাদের স্বজনদের জানার অধিকার রয়েছে। এসব জানার পর রোগী ওই চিকিৎসা নেবেন কি না সে সিদ্ধান্ত নেবেন।'
বাংলাদেশে রোগীরা চিকিৎসা পেতে গিয়ে এসব অধিকার পূরণ করতে পারছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের ডাক্তাররা চেষ্টা করলেও কিছুটা ঘাটতি আছে। অধিক রোগীর চাপে সময়স্বল্পতার কারণে ডাক্তাররা রোগীকে সাইকোলজিক্যাল ও ইমোশনাল সাপোর্ট দিতে পারেন না। এখন রোগীরা অনেক বেশি সচেতন, তাই ডাক্তারদের আরো বেশি কমিউনিকেটিভ হতে হবে।'
রেফারেল সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে
অধ্যাপক শারমীন বলেন, 'বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংকট মোকাবিলায় রেফারেল সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যেসব রোগের সমাধান হয় সেসব রোগীর চিকিৎসা সেখানেই হলে ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ওপর চাপ কমবে।'
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও একই রকম
ঢাকার বাইরেও প্রাইভেট চেম্বারগুলোর অবস্থা প্রায় একইরকম।
রাজশাহীর ৭-৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রায় ২০০ চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। অধিকাংশ ডাক্তার বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতিদিন ১০০-র বেশি রোগী দেখেন। রাজশাহীতে ডাক্তাররা একসাথে ৭-৮ জন রোগী দেখেন এবং রোগীদের কথা না শুনেই টেস্ট বা প্রেসক্রিপশন দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ২৬ মার্চ রাজশাহীর পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্ত্রীকে গাইনি ডাক্তার দেখান সাংবাদিক বুলবুল হাবিব।
তিনি বলেন, 'আরও সাত-আটজন রোগীর সাথে আমার স্ত্রীকেও ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকানো হয়। সেখানে রোগীর কোনো প্রাইভেসি নেই। ডাক্তার আমার স্ত্রীকে কয়েকটা টেস্ট করতে বলে প্রেসক্রিপশন লিখে দেন। ১ হাজার টাকা ফি দিয়েও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি।'
বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরাও স্বীকার করেছে যে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও দেরিতে ডাক্তার দেখাতে হয় এবং ডাক্তাররা যথেষ্ট সময় দেন না বলে অভিযোগ করেন অনেক রোগী।
ঢাকাসহ সারা দেশে ৮০০ ডাক্তার চেম্বার করে ল্যাবএইডের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সিরিয়াল দিয়ে ঠিক সময়ে রোগী না দেখা ও সময় কম দেয়ার বিষয়ে রোগীদের অভিযোগ সত্যি বলে স্বীকার করেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এ এম শামীমও।
তিনি বলেন, 'যে পরিমাণ রোগী দেখার কথা তার চেয়ে বেশি রোগী দেখা, একাধিক জায়গায় চেম্বার করা, ইমারজেন্সি রোগী, যানজট—এসব কারণে ডাক্তাররা রোগীদের ঠিক সময়ে দেখতে পারেন না। এসব কারণে রোগীদের সময়ও কম দেন।'
'তবে এসব সমস্যা সমাধানে ডাক্তারদের ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করব। ডাক্তাররা রোগীদের নির্দিষ্ট যে সময় দেন, সেই সময়ে রোগী দেখতে না পারলে দুই ঘণ্টা আগে যাতে আমাদের জানান সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করবম' যোগ করেন তিনি।
ইউনাইটেড হাসপাতালের মিডিয়া ও কমিউনিকেশন শাখার প্রধান সাজ্জাদুর রহমান শুভ টিবিএসকে বলেন, প্রাইভেট চেম্বারে ডাক্তার দেখাতেও রোগীদের অপেক্ষা করতে হয়, এমন অভিযোগ তারাও পান।
তবে তাদের হাসপাতালে ডাক্তারেরা অনেক সময় নিয়ে একেকজন রোগী দেখেন বলে সিরিয়ালের পরের রোগীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় বলে দাবি করেন তিনি।
শুভ বলেন, 'রোগীদের ঠিক যে সময় দেওয়া হবে, সেই সময়ে যাতে ডাক্তারেরা দেখেন সেজন্য আমরা কাজ করছি।'