ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দামে আগুন লেগেছে: জাতিসংঘ
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া, ক্রেমলিনের ভাষায় যা কিনা- 'বিশেষ অভিযান'। যুদ্ধকে যে নামেই ডাকা হোক- চিরকাল তার মূল্য দেয় আপামর জনতা। আর এবার বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন অঞ্চলগুলোর একটিতে লড়াই-সংঘাত চলমান থাকায়- তার আঘাত ঠিকড়ে পড়েছে বিশ্ববাজারেও। ফলে গেল মার্চে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্য সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে বলে জানাচ্ছে জাতিসংঘ।
বিশ্ব সংস্থাটির মাসিক খাদ্যমূল্য সূচক প্রকাশিত হয় গতকাল শুক্রবার (৮ মার্চ)। এতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইউএন-ফাও) জানিয়েছে, রান্নার তেল, দানাদার শস্য ও মাংসের দাম এখন স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ, ফলে খাদ্যপণ্য কেনার খরচ গত বছরের শেষের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে।
কৃষ্ণসাগর এলাকার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশই গম, ভুট্টা, যবসহ বিভিন্ন প্রধান দানাদার শস্য এবং ভোজ্যতেলের সরবরাহক। যুদ্ধের কারণে অঞ্চলটি থেকে এসব আবশ্যক পণ্যের রপ্তানি তলানিতে নেমেছে। ইউক্রেন বিপুল মজুদ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি করতে পারছে না। আবার, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য রাজনৈতিক চাপের কারণে রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানিও ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ববাজার তাই চাহিদার তুলনায় যোগানের স্বল্পতার ধ্রুপদী সংকটের ঘূর্ণাবর্তে। সুযোগ সন্ধানী আন্তর্জাতিক কমোডিটি ট্রেডারদের চক্র, স্থানীয় মজুতদারি দেশে দেশে দিশেহারা করছে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষকে।
যুদ্ধের কারণে দানাদার শস্যগুলোর দাম গত মাস জুড়ে বাড়ে ১৭ শতাংশ।
মার্চে গমের দাম বিশ্ববাজারে আতঙ্ক জন্ম দিয়ে আরও চড়েছে ১৯.৭ শতাংশ। ভুট্টার দাম মাসওয়ারি হিসাবে ১৯.১ শতাংশের আগুনগতি নিয়ে সহাবস্থান করছে যব ও জোয়ারের সাথে রেকর্ড উচ্চতায়।
ফাও জানিয়েছে, উচ্চ দরের এই সমস্যা সামনেও বজায় থাকার অশনি সংকেত দেখছে তারা। তখন বিভিন্ন দেশের খাদ্য মজুদ যেমন আরও কমবে, তেমনি তেঁতে থাকবে খাদ্যপণ্যের বাজার। বিশ্বের প্রধান শস্য গমের সরবরাহ ও উৎপাদন ঘিরে অনিশ্চয়তা- সংকটকে অতলে নিয়ে চলেছে।
"যেসব দেশ এরমধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা-কবলিত তাদের জন্য উচ্চমূল্যের বোঝা সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় রূপ নিয়েছে"- বলে উল্লেখ করে ফাও- এর মুখপাত্র। তিনি আরও জানান, স্বল্প-আয়ের দেশগুলো এত বেশি দাম দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, "যেসব দেশে নাগরিকদের মোট আয়ের মধ্যে খাদ্যের পেছনে খরচের পরিমাণ কম, বা যাদের এখাতে ব্যয়ের সামর্থ্য সীমিত—তারা এখন অনাহারে থাকার ঝুঁকিতে পড়েছে। নাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বাসস্থানের মতো সুবিধার পেছনে তাদের ব্যয় কমিয়ে কোনোমতে খাদ্যের সংস্থান করতে হচ্ছে। এমন অবস্থা তাদের স্বাস্থ্য ও জীবনমানে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব যোগ করবে।"
এবিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো জোসেগ গ্লবার জানান, সীমিত বৈশ্বিক সরবরাহ পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগেই খাদ্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায় ছিল।
"সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অধিকাংশ দেশের খাদ্য মজুদ ছিল তুলনামূলক অনেক কম, ফলে বাড়তি মূল্যের আঘাত থেকে স্থানীয় বাজারকে রক্ষা করার মতো সরবরাহ অনেক দেশের কাছেই নেই। কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকে আমদানিতে ভাটা পড়ার চাপ তারা নিতে পারবে না।"
আইএফপিআরআই- এর হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের মোট ক্যালোরির ১২ শতাংশের যোগান দেয়।
খাদ্যমূল্যের অস্থিতিশীলতা বিশ্বের সব প্রান্তে অনুভূত হচ্ছে বলে জানান গ্লবার। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানির ওপর যেসব দেশ নির্ভরশীল ছিল তাদের এখন ইউরোপিয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আর্জেন্টিনা থেকে গম চালান কিনতে হবে।
"খাদ্য নিরাপত্তাহীন অধিকাংশ দেশ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের, যেখানে গম মোট ক্যালোরির ৩৫ শতাংশ যোগান দেয়। আর তাদের বেশিরভাগ গম আমদানি করতে হতো কৃষ্ণসাগর অঞ্চল থেকেই"- যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান