কণা পদার্থবিজ্ঞানের নতুন গবেষণা, বিপ্লব আনতে পারে পদার্থবিদ্যার দর্শনে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল পদার্থবিজ্ঞানী সম্প্রতি নতুন একটি গবেষণায় অতি-পারমাণবিক কণা'র ভরের হেরফের দেখতে পেয়েছেন।
ফার্মিল্যাব গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা তাদের পরীক্ষায় জানতে পেরেছেন, এর আগে পদার্থবিজ্ঞানীরা ডব্লিউ বোসন কণার ভর যতটা ধারণা করেছিলেন, তার তুলনায় এটি বেশি ভারী।
আমাদের মহাবিশ্বে মৌলিক বল চারটি। মৌলিক বলগুলো স্বাধীন, অর্থাৎ এগুলো অন্য কোনো বল থেকে তৈরি হয় না, বরং অন্যান্য বল এ চারটি মৌলিক বলের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ।
মৌলিক চারটি বল হচ্ছে- মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চুম্বকীয় বল, সবল নিউক্লিয় বল, ও দুর্বল নিউক্লিয় বল। দুর্বল নিউক্লীয় বলের বাহক কণাগুলো হচ্ছে ডব্লিউ ও জেড বোসন কণা।
বর্তমানে প্রাপ্ত ফলাফল পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেলের সাথে সাংঘর্ষিক। এ ঘটনাকে 'আলোড়ন সৃষ্টিকারী' বলে অভিহিত করেছেন প্রকল্পের সাথে জড়িত একজন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেভিড টোব্যাক।
এ ফলাফল থেকে যদি নতুন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব হয়, তাহলে এর দ্বারা বিজ্ঞানীরা এ মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে- তা নিয়ে আরও স্বচ্ছ ও সম্পূর্ণ ধারণা পাবেন।
প্রফেসর ডেভিড বলছেন, 'প্রাপ্ত ফলাফল যদি আরও কিছু পরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে পৃথিবী বদলে যাবে।' তিনি এটিকে 'প্যারাডাইম শিফট' হিসেবে উল্লেখ করেন।
'বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান একদা বলেছিলেন, বিশেষ দাবির জন্য বিশেষ প্রমাণ থাকতে হয়। আমাদের বিশ্বাস আমাদের কাছে সে প্রমাণ আছে,' বলেন এ অধ্যাপক।
ফার্মিল্যাব-এর বিজ্ঞানীরা ডব্লিউ বোসন কণার ভরে যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন, তার পরিমাণ খুবই কম- কেবল ০.১ শতাংশ। কিন্তু যদি অন্যান্য কয়েকটি গবেষণাপ্রাপ্ত ফলাফল এ ডেটাকে নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে বাস্তব জীবনে এর প্রভাব হবে সাংঘাতিক।
গত পঞ্চাশ বছরে পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্তমান গবেষণা তেমনটাই ইঙ্গিত করছে।
এই প্রকল্পের সাথে জড়িত আরেকজন অধ্যাপক (বিজ্ঞানী) জানান, ফলাফল দেখার পর আমরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বারবার ভুল খোঁজার চেষ্টা করেও, কোনো ভুল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জার্নাল সায়েন্স-এ ফলাফলটি প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে ফার্মিল্যাব ও লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার-এর কয়েকটি পরীক্ষায় এ ধরনের কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। ওই পরীক্ষাগুলো এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। তবে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেল থেকে বিচ্যুতির ইঙ্গিত দিয়েছে। এ ফলাফলের কারণ- এখন পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত কোনো পঞ্চম মৌলিক বল হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
তবে অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা টের পেয়েছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কিছু নতুনত্বের প্রয়োজন রয়েছে। এটি মহাশূন্যের অদৃশ্য বস্তু- ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, মধ্যাকর্ষণ শক্তির ব্যাখ্য দিতে পারে না। ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ত সম্প্রসারণের কারণও স্ট্যান্ডার্ড মডেল দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ড. মিতেশ প্যাটেল লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার-এ কাজ করেন। তার মতে, ফার্মিল্যাবের বর্তমান ডেটাগুলো যদি অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত হয়, তাহলে তা হবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের পর পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন।
তবে সামগ্রিক ব্যাপারটি নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় উত্তেজনা তৈরি হলেও, তার লাগাম কিছুটা টেনে ধরতে হচ্ছে আপাতত। ডব্লিউ বোসনের ভর নির্ণয়ের অন্যতম নির্ভরশীল পরিমাপণ পদ্ধতি হচ্ছে ফার্মিল্যাবের গবেষণা প্রক্রিয়া। তবে আরও দুইটি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে ফার্মিল্যাবের ফলাফলে কিছু ভিন্নতা রয়েছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী বেন অ্যালানাক বলছেন, ফার্মিল্যাবের গবেষণা ও বাকি দুইটি গবেষণার মধ্যে যে ভিন্নতা পাওয়া গেছে- তা সত্যিই চিন্তার বিষয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 'বর্তমানে বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত ডেটাগুলো যদি সত্যি হয়, তাহলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে পদার্থবিজ্ঞানে। নতুন একটি মৌলিক বল খুঁজে পেলে বিজ্ঞানীদেরকে তার জন্য নতুন বাহক কণা সংজ্ঞায়িত করতে হবে।'
এক্ষেত্রে বর্তমান ফলাফলের আরও পরীক্ষা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে- তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটি একটি বড় পরিবর্তন। তাই এর জন্য শক্তপোক্ত প্রমাণের প্রয়োজন। কেবল ফার্মিল্যাবের গবেষণার ফলাফল দিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন না বিজ্ঞানীরা। তাই আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একই পরীক্ষাটি লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার-এ পুনরায় করা হবে।'
আপাতত সবাই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় আছেন। ড. প্যাটেল বলছেন, 'এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা আগেও হয়েছিলাম, কিন্তু বারবারই আমাদেরকে ব্যর্থমনোরথ হতে হয়েছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, একটা কিছু দফারফা হবে। আশা করি, আমরা এমন কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি, যা এতদিন কেবল ইতিহাসের বইয়ে পড়ে এসেছি।'
- তথ্যসূত্র: বিবিসি