পটলের দোলমা: বাঙালির অতিপরিচিত এই পদটিও যখন বিদেশি
শীতকালে বাঙালির পাতে থাকে হরেক রকমের পদ। বছরের এ সময়টাতে শাকসবজির অভাব হয় না বলে ভোজনপটু বাঙালির তিনবেলা আহারে ব্যঞ্জনের বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো হয়।
কিন্তু গ্রীষ্মকালটা ঠিক অতটা দয়ালু নয়। প্রচণ্ড গরমে এমনিতেই দেখেশুনে খেতে হয়, তার ওপর অল্প কয়েক জাতের বাইরে তেমন আনাজপাতি পাওয়াই যায় না।
কয়েক রকমের শাক, ডাঁটা, ঝিঙে, মোচা, এঁচোড়—এসবই ঘুরেফিরে গ্রীষ্মের প্রতিবেলা পাতে পড়ে গড়পড়তা বাঙালির।
গরমে অবশ্য আরেকটি তরকারি বাঙালির পাতে বেশরকম শোভা পায়। সেটি হচ্ছে পটল। পটল দিয়ে হরেকরকম পদ বানানো যায়। পুর, ভাজি, দোলমা, ঝোল ইত্যাকার পদের জন্য এ সবজিটির জুড়ি নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাঙালির এ অতিপরিচিত সবজিটি দিয়ে তৈরি করা পটলের দোলমা কিন্তু আদতে বাঙালির নিজস্ব পদ নয়।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, দোলমা হচ্ছে আনাতোলিয়ান, লেভান্টাইন, ককেশিয়ান, মেসোপোটেমিয়ান, ইরানিয়ান, ও মগরেব অঞ্চলের খাবার। এটা গরম গরম খাওয়া যায়, আবার স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রাতেও পরিবেশন করা যায়।
এখানে কিছু দোলমা সবজি, ফল, সিফুড দিয়ে তৈরি করা হয়। আবার কোনো কোনো দোলমার ওপরে আঙুর, বাঁধাকপি, ও অন্যান্য সালাদা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, সোজা কথায় সেই সুদূর ভূমধ্যসাগরের পাড় থেকে যাত্রা শুরু করে দোলমা এসে থেমেছে এই বঙ্গোপসাগরের পাড়ের দেশে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, বাংলায় নবাবদের শাসনামলে তুর্কিদের হাত ধরে দোলমা প্রথম অঞ্চলে এসেছিল।
অন্য ইতিহাসবিদদের মতে, ব্রিটিশদের আগে কলকাতায় বাস করা গ্রীক ও আর্মেনিয়ানদের মাধ্যমেই বাঙালি দোলমার সাথে পরিচিতি লাভ করে।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে দোলমার পুরের জন্য বিভিন্ন শাকসবজি ব্যবহার করা হতো। এসব সবজির মধ্যে ছিল টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ, ধুন্দল, বেগুন ও পটল। পুরের উপাদান হিসেবে আরও থাকতো ভাত, মাংসের কিমা, পেঁয়াজের টুকরা, শুলফা, পুদিনা, ও মসলা।
কয়েকশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের খাবারে দোলমার দেখা মেলে। ইরাকি দোলমায় বাঁধাকপির পাতার পুর, টমেটো সসে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা বেগুনের পুর এসবও থাকে। সময়ের সাথে সাথে অঞ্চলভেদে দোলমায় নানা বৈচিত্র্য দেখা গেছে। পারসিয়ান উপসাগর অঞ্চলে দোলমায় থাকে বাসমতী চাল। এগুলোতে সুগন্ধির জন্য ব্যবহার করা হয় টমেটো, পেঁয়াজ ও জিরা।
'দোলমাক' বা 'দোলমাদ' শব্দ থেকে দোলমা শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এটি একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ 'পূর্ণ করা'। বাঙালির রান্নাঘরের দোলমায় থাকে মাছ, চিংড়ি, মাংস, সবজি, পোস্তদানা, কোরা নারকেল, ও কিশমিশ।
পটলের দোলমা যেমন হেঁশেলের নিয়মতি পদ হতে পারে, আবার বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানেও এটিকে অনায়াসে ব্যঞ্জনতালিকায় রাখা যায়।
পটলের দোলমা বাংলায় প্রচলনের জন্য সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি দেওয়া হয় আর্মেনিয়ানদের। ব্রিটিশদের আগে কলকাতায় আর্মেনিয়ানরা সমৃদ্ধ জীবন যাপন করত। এ জাতি বেজায় ভোজনরসিক ছিল। বিভিন্ন উৎসবে বনেদি বাঙালির জন্য তারা দারুণ সব খাবারের আয়োজন করত। এসব অনুষ্ঠান থেকেই দোলমার সাথে বাঙালির পরিচয় ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এরপর দোলমাকে নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিয়েছে বাঙালি। দোলমায় তারা ব্যবহার করেছে ঘি, ময়দা, জিরার গুঁড়ো, হিং, লঙ্কা, আদা, বাদাম, ও কোরা নারকেল।
বাঙালির রয়েছে নিরামিষ দোলমাও। বাঙালির দোলমাতে এখনো কেবল পটলই ব্যবহার করা হয়, কারণ অন্য সব সবজি দিয়ে দোলমা রান্না করলে তা ঠিক জমে না।
- সূত্র: গেটবেঙ্গল ডট কম