চকলেটের কারখানা দিলেন নিজেরাই!
নিষাদ আর পূর্ণার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। পূর্ণা নিষাদের জন্য পছন্দের উপহার কিনতে শপিংমলে চকলেট সেক্টরে ঘুরছিলেন। সে এমন চকলেট খুঁজছিল যা নিষাদকে চমকে দেবে। কিন্তু, তেমন চকলেট চোখে না পরায় কিছুটা হতাশই বোধ করছিল। এমন সময় দোকানের সেলসম্যান তাকে একটি ডার্ক চকলেট দেখায়। সাথে বিশেষভাবে উল্লেখ করে যে, এটি আমাদের দেশেই তৈরী ক্রাফট চকলেট। আর এটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি 'ঝাল ফ্লেভারের' চকলেট। এমন একটি ভিন্ন স্বাদের চকলেট পেয়ে পূর্ণা যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। নিষাদকে চমকে দেয়ার জন্য এমন কিছুই তো খুঁজছিল সে!
মানসম্পন্ন ক্রাফট চকলেটের এই দোকানের নাম 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি'। যমুনা ফিউচার পার্কের লেভেল-৫ এর সেন্ট্রাল কোর্টে অবস্থিত। কোকো ছাড়াও অন্যান্য ফ্লেভারের চকলেট পাওয়া যাবে এই দোকানে। দোকানের স্বত্বাধিকারী কামরুন নাহার ঝুমুর। দেশী ক্রাফট চকলেট উৎপাদন এবং বিপণনের জন্য 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি' ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম অর্জন করেছে। চকলেটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়াতে সমমনাদের সাথে যুক্ত হয়ে তৈরী করেছেন 'কোকো ল্যাব চকলেট' কোম্পানি। এখানেই তৈরি হয় দেশীয় ব্রান্ডের হ্যান্ডিক্রাফটেড চকলেট।
কী পাবেন চকলেট এন্ড পেস্ট্রিতে
হোয়াইট চকলেট, ডার্ক চকলেট, মিল্ক চকলেট, বিটারসুইট চকলেট, ক্যান্ডি কোটেড চকলেটসহ হরেক রকমের চকলেট বাজারে পাওয়া যায়। এ ধরনের চকলেটের অধিকাংশই আমদানির মাধ্যমে আমাদের দেশে আনা হয়। চকলেট এন্ড পেস্ট্রিতেও আমদানিকৃত সব চকলেটই বিক্রি করা হয়। যেমন, ক্যাডবেরি ডেইরি মিল্ক, পার্ক, সাফারি, লোকার, ক্যারামেল চকলেট টুইক্স, টোবল্যারন ইত্যাদি। পাশাপাশি নিজস্ব কারখানায় তৈরী ক্ল্যাস্টার চকলেটসহ নানা ধরনের চকলেট মিলবে ঝুমুরের দোকানে। সম্প্রতি, ডার্ক চকলেটের সাথে কফি ক্রিমের সমন্বয়ে তৈরি করা একটি আইটেমও সংযোজন করা হয়েছে। চকলেট এন্ড পেস্ট্রিতে খেজুরের তৈরি ট্রাফেল জাতীয় চকলেটও সমানভাবে জনপ্রিয়। এছাড়াও দোকানটিতে সীমিত পরিসরে শিশুদের জন্য রয়েছে নানা রকমের খেলনা সামগ্রী।
কোকো ল্যাবের বিশেষ আইটেম
কোকোর তৈরী ক্রাফট চকলেটের বেলায় সাধারণত মিষ্টি চকলেটেরই প্রভাব রয়েছে। এই ধারণায় ছেদ ঘটাতে কোকা ল্যাব চকলেটের কারখানায় তৈরী হচ্ছে ভিন্ন স্বাদের ক্রাফট চকলেট। এদের মধ্যে আছে মরিচের ঝাল ফ্লেভারের চকলেট, খেজুর এবং কাজুবাদামের মিশ্রণে তৈরি চকলেট, কমলা ফ্লেভারের চকলেটসহ আরো কিছু মজাদার স্বাদের চকলেট।
দেশী ক্রেতার কথা মাথায় রেখেই কোকো ল্যাবের তৈরী চকলেটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। নিজস্ব কারখানায় তৈরি চকোলেট বারের মূল্য মাত্র ২৪০ টাকা করে। কোকো ল্যাব লাক্সারিয়াস ট্রাফেলস পাওয়া যাবে ৩৫০ টাকায়। ১৬০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি খেজুরের চকলেট বিক্রি হয় ২৫০ টাকা করে। এছাড়া, বিশেষ মূল্য ছাড়ে প্রতিটি চকলেটেরই কম্বো প্যাকেজগুলো তো রয়েছেই।
ক্রেতা কারা
চকলেটের প্রধান এবং প্রথম ভোক্তা হিসাবে শিশুদেরই চিন্তা করা হয়। তবে চকলেট এখন শিশুদের পাশাপাশি বড়দের কাছেও সমান জনপ্রিয়। যমুনা ফিউচার পার্কের লেভেল-৫ এর দোকানটিতে ক্রেতা মূলত শিশুদের পাশাপাশি উঠতি বয়সীরাও। তাদের কর্পোরেট ক্রেতার মধ্যে আছে, অপসোনিন ফার্মা, রবি-টেন মিনিটস স্কুল, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স, আমেরিকান অ্যাম্বাসি এবং কক্সবাজারসহ দেশের অভ্যন্তরের বেশ কিছু পাঁচতারকা হোটেল। বিভিন্ন উৎসবে এবং বিশেষ কোনো দিবস উপলক্ষে 'কোকো ল্যাব চকলেট' কোম্পানি বিভিন্ন রকম ক্রাফট চকলেট তৈরী এবং সরবরাহ করে থাকে।
কোকো ল্যাবের শুরুর গল্প
২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন দেশীয় ক্র্যাফট চকলেট কারখানা 'কোকো ল্যাব চকলেট'। দেশে এটিই প্রথম কারখানা যারা নিজেরা ক্র্যাফট চকলেট উৎপাদন করছে।
কোকো ল্যাব চকলেটের শুরুর গল্পটা বেশ মজার। আবু দাউদ বিশ্বাস এবং মুনিরা জোবাইদা দম্পতি তখন হানিমুনে মালয়েশিয়াতে গিয়েছেন। কুয়ালালামপুর ভ্রমণের সময়ে ক্রাফট চকলেটের আইডিয়া পান তারা। এরপর দেশে ফিরে এসে চকলেট সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করেন বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে। ৩৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন চকলেটের ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানের সহ-উদ্যোক্তা আবু দাউদ বিশ্বাস বলেন, "আমরা বিএসটিআই এর যাবতীয় শর্ত পূরণ করে এবং অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালু করেছি"। তিনি আরো জানান সুপার শপগুলোতে তাদের পণ্যের চাহিদা আছে। তবে, সুপারশপকেন্দ্রিক ব্যবসায়ে যে বড় অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন- সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে অনলাইনে চকলেটের চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেয়াটা বেশ সহজ। এ কারণে অনলাইনেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি তাদের। কোকো ল্যাব চকলেটের বিশেষত্ব হলো, তাদের পণ্যের গুণমান। আর এই মান বজায় রাখতে প্রতিষ্ঠানটি বদ্ধপরিকর।
বর্তমানে ব্যবসার হাল-হকিকত
কামরুন নাহার ঝুমুর বলেন, "ব্যবসায় আমরা নতুন। তবে শুরুর দিকে অনলাইন এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ ভাল সাড়া পেয়েছি। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা হলেও করোনা মহামারিতে অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো আমাদেরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে, 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি' যেহেতু ভাড়া নেয়া দোকান, এখানে ব্যবসা না চললেও আপনার প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একটি খরচ থাকবে"।
যমুনা ফিউচার পার্ক চালু হবার সময়ে ঝুমুরের 'চকলেট ওয়ার্ল্ড' নামে একটি দোকান ছিল। এটিই বর্তমানে 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি'। ঝুমুরের সাথে কথা বলে জানা যায়, পূর্বে সংবাদকর্মী হিসাবে চাকরি করতেন তিনি। একসময় চাকরি ছেড়ে চকলেট ব্যবসা শুরু করেন। এখান থেকেই তার সাথে পরিচয় হয় আবু দাউদ বিশ্বাস এবং অন্যান্যদের সাথে। পরবর্তীতে, কোকো ল্যাব ফ্যাক্টরিটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লে ঝুমুর এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার বনে যান। কোকো ল্যাব চকলেটে ঝুমুরের ২৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে বলে জানান তিনি। দাউদ বিশ্বাসের মতে, এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লভ্যাংশের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অনলাইনে ব্যবসায়ের পাশাপাশি, 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি' দোকানটি বেশিরভাগ সময়ই থাকে ক্রেতামুখর। 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি'তে আসা হাসান মাহমুদ জানান, তিনি তার ভাগ্নির জন্য এখান থেকেই চকলেট কিনে থাকেন নিয়মিত। তার ভাগ্নি এখানকার ক্লাস্টার চকলেট খুবই পছন্দ করে।
কোকো ল্যাব চকলেট কারখানা এবং চকলেট এন্ড পেস্ট্রিতে বর্তমানে ১০ জন কর্মচারী রয়েছেন। প্রতিমাসে দোকানের কর্মীদের বেতন বাবদ ঝুমুরের খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা।
স্বাদ ও মানের প্রশ্নে সমঝোতা নয়
চকলেট একটি শৌখিন খাদ্য। এজন্য এটির ভোক্তারা মানের প্রশ্নে আপোষহীন থাকেন। আমাদের দেশীয় অধিকাংশ চকলেট খাওয়ার পরে জিভে একপ্রকারের তৈলাক্ত অবস্থা তৈরী হয়। এর কারণ, এতে ভেজিটেবল ফ্যাট ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে, কোকো ল্যাব চকলেটে কোকো এবং অন্যান্য উপাদান সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয়। এতে করে পণ্যের স্বাদ এবং মান অক্ষুণ্ণ থাকে। কোকো ল্যাব চকলেটের কাঁচামাল বেশিরভাগই আমদানি করা হয় সিঙ্গাপুর থেকে।
তাছাড়া আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভ্যান এবং স্টোর রুম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোকোর তৈরী পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে এর বিকল্প নেই বলে জানান ঝুমুর। তিনি আর বলেন, "ভোক্তারা পণ্য কিনতে আগ্রহী, তবে সে অনুপাতে আমাদের দেশে সঠিক মান নিয়ন্ত্রিত চকলেট কারখানা গড়ে ওঠেনি। আমরা সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ করে চকলেট তৈরি করে থাকি। এ কারণে, কিছু পণ্যের দাম অনেকের কাছে কিছুটা বেশি বলে মনে হয়। কোকো যেহেতু ব্যয়বহুল, তাই কোকোর তৈরি চকলেটের দামও বেশি। তবে, মূল্য যেন ক্রেতার ক্রয়সীমার বাইরে না চলে যায় সে বিষয়েও আমরা সচেষ্ট"।
যমুনা ফিউচার পার্কের বাইরে আপাতত 'চকলেট এন্ড পেস্ট্রি'র আর শাখা নেই। তবে ভবিষ্যতে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন চকলেট উৎপাদন ও দেশের বাজারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন ঝুমুর।