কাঁচামাল সরবরাহের অর্থ সময়মত না পাওয়ার অভিযোগ টেক্সটাইল মিলারদের
ইসরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের কাছে কাঁচামাল হিসেবে ইয়ার্ন বা সুতা সরবরাহ করার পর যে সময়ে অর্থ পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। তিন মাসের মধ্যে টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি আরও ছয় মাস সময় লেগে গেছে।
ইসরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মোঃ ফজলুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ পর্যন্ত তার প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলারের পাওনা বাকি পড়ে আছে। তিনি যা বিক্রি করেছেন, তার প্রায় ৯৮ শতাংশ পাওনাই সময়মত পাননি।
তিনি জানান, এ কারণে তার অনেক বেশি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগছে। অন্যদিকে, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে তারা কোনো ছাড় পাচ্ছেন না, ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
কেবল ইসরাক টেক্সটাইল মিলস নয়, খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাক টু ব্যাক এলসির (লেটার অফ ক্রেডিট) আওতায় বিক্রি করা প্রায় সব টেক্সটাইল মিলই এই সমস্যা মোকাবেলা করছে।
টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এই ইস্যুর সমাধান চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। গত রোববার (১৭ এপ্রিল) বিটিএমএ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পেমেন্ট নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংকগুলোকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সময়মত অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার জন্য সুদ পরিশোধের দাবিও জানিয়েছেন সংগঠনটি।
একই দিনে সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর ইয়ার্ন ও ফেব্রিকের মূল ক্রেতা দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প খাত। এ খাতের নেতারা দেরিতে অর্থ পরিশোধের বিষয়টি স্বীকার করলেও এর পেছনে বিদেশি আমদানিকারক বায়ারের কাছ থেকে অর্থ পেতে দেরি হওয়া কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ না পাওয়াকে দায়ী করেছেন।
তবে টেক্সটাইল মিল মালিকরা বলছেন, বিদেশ থেকে সুতা বা কাপড় আমদানির ক্ষেত্রে তো পোশাক শিল্প মালিকরা দেরি করতে পারেন না। তাহলে কেনো স্থানীয় টেক্সটাইল মিল মালিকদের অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করছেন?
টেক্সটাইল মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ক্রেতার কাছে (মূলত রপ্তানিমুখী পোশাক খাত) ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে পণ্য পাঠান। এর প্রক্রিয়া হলো, প্রথমে পণ্যের দাম ও কবে সরবরাহ করা হবে, তা উল্লেখ করে ক্রেতার কাছে প্রোফরমা ইনভয়েস পাঠানো হয়, যা পিআই নামে পরিচিত। এতে ক্রেতা রাজি হলে সংশ্লিষ্ট মিল ট্রাক রিসিপ্ট ও ডেলিভারি চালানের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করে।
পণ্য সরবরাহের দুটি ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হল 'অ্যাট সাইট কন্ডিশন', যাতে পণ্য পাঠানোর পরে ক্রেতা ডকুমেন্ট পাওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করবে। আরেকটি হল 'ডেফার্ড পেমেন্ট কন্ডিশন', যাতে ডকুমেন্ট পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু এ দুটির কোনোটি ক্ষেত্রেই মূল্য পরিশোধের শর্ত মানা হচ্ছে না বলে টেক্সটাইল মিল মালিকরা অভিযোগ করেছেন।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, রপ্তানিকারক হিসেবে সুতা ও ফেব্রিক রপ্তানিকারক মিলগুলোর এখন প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই পেমেন্টে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত দেরি হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নয় মাসও দেরি হয়েছে। এ কারণে একেকটা মিলের প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রয়োজন হচ্ছে কিংবা ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, "অথচ বিদেশ থেকে ইয়ার্ন ও ফেব্রিক আমদানির ক্ষেত্রে, আমদানিকারক শিপিং কোম্পানির কাছ থেকে বিল অব লেডিং (বিএল) পাওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে বিল পরিশোধ করতে হয়।"
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তারা তো (টেক্সটইল মিলাররা) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গেছে। আমরা যে রপ্তানির অর্থ দেরিতে পাই কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাই না, আমরা কার কাছে যাবো? তারাতো দেরিতে হলেও টাকা পায়, আমরা তো কখনো কখনো পাইই না। বিশেষত, কোভিডের সময় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পেমেন্ট আসেনি। কিন্তু তাদের টাকা দেরিতে হলেও তো আমরা পরিশোধ করেছি।"
প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধে দেরির অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে নিজের কারখানার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পেমেন্টে তিনি কিছুটা দেরি করেছেন। বাকি পেমেন্ট সময়মতই হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "দেশের ইমেজ রক্ষার্থে সেক্ষেত্রে দেরি করা হয় না।" তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেরি হয় বলে জানান তিনি।
বিটিএমএ'র সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সংগঠনটির সদস্যভুক্ত টেক্সটাইল মিলের সংখ্যা দেড় হাজারের ওপরে। এরমধ্যে ডিম্ড এক্সপোর্টার (যারা রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার কাছে বিক্রি করে) সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ।
বাংলাদেশ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো বিটিএমএ'র চিঠিতে আলোচ্য ইস্যু ছাড়াও ৬টি বিষয় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
এরমধ্যে টেক্সটাইল মিলের জন্য ইডিএফ ফান্ডের লিমিটি বিদ্যমান ২৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪০ মিলিয়ন ডলার এবং তা এক বছরের জন্য করা, ব্যংক ঋণের (সিসি বা ব্যাক টু ব্যাক এলসি) লিমিট তিনগুণ বাড়ানো এবং কোভিডকালীন সুদ মাফ করা, অন্যথায় তা সমন্বয়ের মাধ্যমে পরবর্তী ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ফান্ড টেক্সটাইল খাতের মিলগুলোকে বরাদ্দের ক্ষেত্রে শর্ত সহজ করার দাবি উল্লেখযোগ্য।