বেসরকারি খাতে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় চিনিকল
পাহাড়সম লোকসান ও পূঞ্জীভূত দেনায় ডুবি ডুবি অবস্থার উত্তরণে সরকারি মালিকানাধীন তিনটি চিনিকল বিদেশি একটি কনসোর্টিয়ামের হাতে ছেড়ে দিতে চাইছে সরকার।
জাপান, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিনটি প্রতিষ্ঠানের শ্যুগার ইন্টারন্যাশনাল কো নামক একটি যৌথ কনসোর্টিয়াম গঠন করে দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ, ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ ও রাজশাহী চিনিকলে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। এই কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্বে রয়েছে আরব আমিরাতের সারকারা ইন্টারন্যাশনাল।
সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে চিনিকলগুলো পরিচালনার এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করতে মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। চিনিকলগুলোর কাছে সুদাসলে ৭,৭০০ কোটি টাকা পাওনাদার রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।
সভা শেষে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) চেয়্যারম্যান মো. আরিফুর রহমান অপু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সারকারা ইন্টারন্যাশনাল তিনটি চিনিকলে বিনিয়োগের যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে আবারও বৈঠক হবে, সেখানে হয়তো চূড়ান্ত হবে।"
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাষ্ট্রায়ত্ব করপোরেশন) এস এম আলম টিবিএসকে বলেন, যৌথভাবে চিনিকলগুলো পরিচালনার জন্য যে অর্থায়নের প্রয়োজন হবে, বিদেশি কোম্পানিগুলোর গঠিত কনসোর্টিয়াম থেকে তা পাওয়া যাবে। সভায় প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। আগামী বুধবার পরবর্তী বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সরকারি মালিকানায় ১৫টি চিনিকল ও ১টি প্রকৌশল কারখানা রয়েছে, যা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলছে। কেরু অ্যান্ড কোং ছাড়া ১৪টি চিনিকলই বড় আকারের লোকসানে রয়েছে।
এছাড়া, চিনিকলের মেশিন মেরামত বা যন্ত্রাংশের উৎপাদক ও বিক্রেতা প্রকৌশল কারখানাটিও লোকসানে রয়েছে।
প্রফিটেবল কেরু অ্যান্ড কোং মূলত অ্যালকোহল উৎপাদনের কারণে ডিস্টিলারি থেকে বড় মুনাফা আসছে। যদিও চিনি সেগমেন্টে বড় লোকসান।
ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বড় সুদ ব্যয়, উৎপাদন ব্যয় ও আখ থেকে আশানুরূপ রস না পাওয়ায় সরকারি চিনিকলে উৎপাদিত প্রতি কেজি চিনির দাম প্রায় ৩০০ টাকা হলেও বিক্রয় মূল্য ৮০ টাকা।
খরচ বেশি হলেও বিক্রি মূল্য কম হওয়ায় বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসান গুণছে সরকারি চিনি কল। ভর্তুকি দিয়ে সরকার মিলগুলো টিকিয়ে রাখতে চাইলেও চিনি উৎপাদনে উন্নতি তো নেই, বরং তা পেছাচ্ছে।
এদিকে, চিনির চাহিদার তুলনায় সরকারি চিনি মিলগুলোর যোগান খুবই কম। দেশে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে, যার ৯০ শতাংশের বেশি মেটায় বেসরকারি খাত। বেসরকারি উদ্যোক্তারা 'র' সুগার আমদানির পর রিফাইন করে চিনি উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে কম ৪৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮২ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়।
চিনি ও খাদ্য শিল্পের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪টি চিনিকলে পুঞ্জীভূত লোকসান ৮০৫১.৩৬ কোটি টাকা। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৯৩৩ কোটি টাকা।
মিলগুলোর মেশিনারিজ পুরনো, নেই পর্যাপ্ত কাঁচামাল, আখ মাড়াই থেকে চিনি আহরণও ক্রমেই কমছে তবুও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১.১৫ লাখ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন। তবে প্রকৃতপক্ষে চিনি উৎপাদিত হয়েছে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন।
মূলত, ৬টি চিনি কলের আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণার কারণে চিনি উৎপাদন কমেছে বলে মনে করছে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন।
২০২০ সালের শেষ দিকে লোকসানে জর্জর ছয়টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। যদিও সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে আধুনিকায়ন করে পুনরায় চালুর প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়। তবে, এখনও মিলগুলো চালু হয়নি।
এদিকে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ মেট্রিক টন।
এবার চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে প্রায় অর্ধেক অর্জিত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, আখ মাড়াই শুরুর পর মিলগুলো প্রায় ৪৫-৫০ দিন চলেছে। কাঁচামাল না থাকায় বেশিদিন চলতে পারেনি মিলগুলো।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) গঠিত হয়। মূলত, বাংলাদেশ শ্যুগার মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনকে একীভূত করে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন গঠিত হয়।