গত ২২ বছরে ঢাকায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা ১৫০টি থেকে নেমে এসেছে ২৪টিরও নিচে
রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের সঙ্গে কমছে শিশুদের খেলার মাঠ। অধিকাংশ মাঠ পুনরুন্নয়নের পরে খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ শিশুরা। গত ২২ বছরে ঢাকায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা ১৫০টি থেকে নেমে এসেছে ২৪টিরও নিচে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির উন্নয়ন কাজ চলছে আবার কোনোটি পরে থাকছে তালাবদ্ধ।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ২০১৬-৩৫ এর জন্য প্রস্তাব তৈরিতে করা জরিপ মতে ঢাকা মহানগরের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। সেখানে নগরের প্রত্যেক সাড়ে ১২ হাজার মানুষের বিপরীতে একটি দুই একরের খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি মেয়রেরও সেই প্রস্তাবনা অনুযায়ী নগরের পরিকল্পনা করার কথা। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন নতুন মাঠের দিকে নজর না দিয়ে যেগুলো বিদ্যমান আছে সেখানে কিছু উন্নয়ন কাজ করে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করে দিচ্ছে। একইসঙ্গে পার্ক ও খেলার মাঠের প্রকল্প নিয়ে কাজ করায় আরও সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে মাঠের পরিধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং জলবায়ুর অভিঘাত রুখতে উন্মুক্ত স্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরি করতে না পারলে এবং সেখানে শিশুদের খেলার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সাথে সাথে সকল বয়সী মানুষের জন্যই দরকার পর্যাপ্ত খালি ও সবুজ স্থান।
দুই সিটি কর্পোরেশন বলছে তাদের আলাদা দুটি প্রকল্পের আওতায় ৪৯টি পার্ক ও খেলার মাঠের কাজ শেষ করে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে খেলার মাঠ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যেখানেই ফাঁকা স্থান পাচ্ছে সেখানেই পার্ক কিংবা খেলার মাঠ তৈরি করা হচ্ছে বলেও দাবি তাদের।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে, কোনো এলাকায় প্রতি পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। যে মাঠের আকার হবে এক একরের। সেক্ষেত্রে ঢাকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য মাঠের প্রয়োজন প্রায় পাঁচ হাজার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যে কোনও শহরের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য প্রায় নয় বর্গমিটার খোলা জায়গা প্রয়োজন এবং এই খোলা জায়গা হওয়া উচিত পার্ক বা খেলার মাঠ। অথচ ঢাকা শহরে এই স্থানের পরিমাণ ব্যক্তিভেদে এক বর্গমিটারেরও কম।
২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপ মতে, দুই সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন এলাকায় কেবল ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে, যার মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে দখল হয়ে আছে ১৬টি মাঠ। এছাড়াও ১৭ সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টি ঈদগাহ রয়েছে। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও কমেছে বলছে সংগঠনটি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মেয়েদের জন্য কোনও খেলার মাঠ নেই। মেয়েরা মাত্র ৭ শতাংশ মাঠে খেলতে পারে।
রাজধানীতে উন্মুক্ত ২৪টি মাঠ আছে যেখানে সিটি কর্পোরেশনের ১৮টি মাঠ রয়েছে। এরমধ্যে উত্তর সিটিতে ৬টি এবং দক্ষিণ সিটিতে আছে ১২টি মাঠ। এর মধ্যেও কিছু খেলার মাঠ আবার সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাঠের সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
এদিকে ২০০০ সালের এক জরিপে দেখা যায়, তখন ঢাকা শহরে খেলার মাঠ ছিল ১৫০টি। যদিও ঢাকার মাঠ নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
সংশোধিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসাবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩৭টিতে কোনো খেলার মাঠ কিংবা পার্ক নেই।
ঢাকার পরিসর বিবেচনা করে, খেলার মাঠের জন্য ১,৮৭৬ একর এলাকা বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ খেলার মাঠের জন্য রয়েছে কেবল ২৯৪ একর।
এই খেলার মাঠগুলোর বেশিরভাগের অবস্থাই শোচনীয়। অধিকাংশই উন্মুক্ত নয়। যেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত সেখানে আবার খেলার উপযোগী ব্যবস্থা নেই। পার্কের চারপাশ আগাছায় পূর্ণ এবং সামান্য বৃষ্টিতেও পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ১৬টি ওয়ার্ডে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র ৭টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ ও পার্ক রয়েছে।
দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠের পরিমাণ এক একরেরও কম। উত্তর সিটির ৪৬ নং ওয়ার্ডে মাত্র ০.৬৩ একর, ৫০ নং ওয়ার্ডে ০.৪৪ একর এবং দক্ষিণ সিটির ৩৮ নং ওয়ার্ডে ০.০৯ একর, ৪০ নং ওয়ার্ডে ০.৩১ একর, ৪৯ নং ওয়ার্ডে ০.৩২ একর, ৭০ নং ওয়ার্ডে ০.১৬ একর জায়গায় খেলার মাঠ রয়েছে।
দক্ষিণ সিটির ২, ৩, ১৬, ২৫, ২৮, ৩৪, ৩৫, ৩৭, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৪, ৬৭, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫- এ ২৭টি ওয়ার্ডে মাঠ কিংবা পার্ক কিছুই নেই। এছাড়া উত্তর সিটির ২১, ২৩, ২৫, ৩০, ৩৫, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১ এবং ৪৭ নং- এ ১০টি ওয়ার্ডেও নেই কিছুই।
রাজউকের ১৯৯৫ সালে মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) অনুযায়ী সে সময় মাথাপিছু সবুজ পরিসরের পরিমাণ ছিল ০.৫ বর্গমিটার। ২০০৯ সালে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকায় মাথাপিছু সবুজ পরিসরের পরিমাণ মাত্র ০.০৫২ বর্গমিটার। বর্তমানে পার্ক ও গণপরিসরের অপর্যাপ্ততা ঢাকার একটি বড় সমস্যা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নেওয়া একটি প্রকল্পের আওতায় ১৮টি পার্ক ও মাঠের কাজের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ সম্পন্ন হয়নি। সম্প্রতি ৭টি পার্ক ও খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে রাজধানীতে ৩১টি পার্ক ও খেলার মাঠ উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নেয় দক্ষিণ সিটি। 'জল সবুজের ঢাকা' নামে পরিচিত এই প্রকল্পের আওতায় আধুনিকায়ন করার কথা ছিল ১২টি খেলার মাঠ। ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও অধিকাংশ খেলার মাঠ দখলমুক্ত করে কাজ শেষ করতে পারেনি। যেসব মাঠের আধুনিকায়ন হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই থাকছে তালাবদ্ধ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, উত্তর সিটিতে নতুন যে ওয়ার্ডগুলো যুক্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিতেই আমরা একটা করে খেলার মাঠ-পার্ক করতে চাই। এজন্য প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, দক্ষিণের প্রতিটি ওয়ার্ডে যাতে একটি করে খেলার মাঠ নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য ৩০ বছর মেয়াদী একটি 'ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান' প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যদি জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়, সেটাও করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এলাকার ডিজাইনে সেই এলাকার জনসংখ্যাকে মাথায় রেখে খেলার মাঠের পরিকল্পনা করা উচিত সিটি করপোরেশনের। এ ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে পাঁচ বছরে যদি একটি করে খেলার মাঠ করার চিন্তা করা হয় তাহলে বছরে আরও ১২৯টি নতুন খেলার মাঠ পাওয়া যাবে।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "গত কয়েক বছরে রাজধানীর মাঠের সংখ্যা বাড়েনি বরং নিয়মিতই কমছে। যেসব খেলার মাঠ এখনও আছে, সেসবের অধিকাংশও বেদখল হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন। ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মানদণ্ড অনুসরণ করে পার্ক-খেলার মাঠ পুরোপুরি নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে কিছু কিছু জায়গায় পুনরুন্নয়নের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কিছু খেলার মাঠ-পার্ক তৈরি করা সম্ভব।"
তিনি আরও বলেন, "গত চার-পাঁচ বছরে কমার্শিয়াল সেক্টরে কিছু মাঠ করা হয়েছে, তবে সেগুলোতে সবার প্রবেশাধিকার নেই। মানুষকে টাকা দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। যেগুলো উন্মুক্ত আছে সেগুলো এক একটি সংস্থা ব্যবহার করছে। এটি একটি সুস্থ নগরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।"
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সচিব ইকবাল হাবিব টিবিএসকে বলেন, "প্রতি ৫ বছরে ঢাকার মাঠ ও পার্কের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমছে। একদিকে সিটি কর্পোরেশন নতুন কোনো জায়য়গায় মাঠ তৈরি করতে পারছে না, অন্যদিকে মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে যেমন সমন্বয় জরুরি তেমনি সবকিছুর আগে শিশুদের কথা মাথায় রাখা উচিত।"
মাঠ আধুনিক হওয়ার পরে তালাবদ্ধ থাকছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, "দক্ষিণের মাঠগুলো পরিচালনার গাইডলাইন এখনও তৈরি না হওয়ায় সেখানকার মাঠগুলো সবসময় উন্মুক্ত থাকছে না। তবে উত্তরে সবাই সুযোগ পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের একটি কার্যকরী কমিটি করে মাঠ ও পার্কগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। রাজধানীতে যেকোনো উন্নয়ন কাজের আগে শিশুসহ সকল বয়সী মানুষের জন্য উন্মুক্ত ও শ্রান্তি স্থানের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।"