মুহিত স্মরণে: হৃদয়ে বহতা সুবাস
চলে গেলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরিণত বয়সেই তাঁর প্রয়াণ—তবু মনে হয় তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন আরো দীর্ঘ হলে আমরাই উপকৃত হতাম তাঁর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞা থেকে। ছাত্রজীবনে ছিলেন তুখোড় শিক্ষার্থী, কর্মজীবনে দক্ষ আমলা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে এবং পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে তাঁর মেধার ছাপ রেখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই দীর্ঘতম সময় ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।
মুহিত সাহেবের সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে পরিচিতি দীর্ঘদিনের—সেই আশির দশক থেকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় নব্বুইয়ের দশকে নিউইয়র্কে। নব্বুইয়ের দশকে আমি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে যোগ দেই। আমাদের দপ্তরটি ছিল ফার্স্ট অ্যাভিনিউ এবং ফর্টি ফিফথের মোড়ে 'উগান্ডা হাউসে'। তার ঠিক উল্টোদিকে মুহিত সাহেবের একটি ফ্ল্যাট ছিল। আমি সে সময়ে মানব উন্নয়ন দপ্তর ও প্রতিবেদনের উপপ্রধান, যার প্রধান ছিলেন পাকিস্তানের ভূতপূর্ব অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী ড. মাহবুবুল হক।
একদিন আমাদের দপ্তরের সামনেই রাস্তায় ড. হক আমার সঙ্গে মুহিত সাহেবের পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথম পরিচয়েই আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তাঁর উদ্যম, প্রাণশক্তি আর গতিময়তায়। তখন তিনি পরামর্শক হিসেবে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের জন্যে 'মানব উন্নয়নের অর্থায়ন' শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র রচনা করছেন।
সেই সূত্রে তিনি প্রায়শই তাঁর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার দপ্তরে চলে আসতেন। চা খেতে খেতে দীর্ঘ আলোচনা হতো আমাদের দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি এ অর্থনীতি সম্পর্কে। আমার কাছ থেকে নানান বাংলা বই তিনি ধার করতেন এবং অতিদ্রুত শেষ করে সেগুলো আবার আমাকে ফেরত দিতেন। কখনও কখনও আমার ঘরের কোনার আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে তিনি বই পড়তেন, আমি দাপ্তরিক টেবিলে বসে আমার কাজ করতাম। আমার ঘরের দেয়াল থেকে মেঝে পর্যন্ত ফরাসী জানালা দিয়ে পূর্বী নদী দেখা যেত। মাঝে মাঝে পড়া ছেড়ে তিনি জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াতেন, চুপ করে নদী দেখতেন। একদিন জল দেখতে দেখতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হেসে বলেছিলেন, 'আমি সিলেটের লোক। হাওড়-নদী দেখে বড় হয়েছি। জলের প্রতি তাই আমার আকর্ষণ বড় প্রবল।'
নানান বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা, জ্ঞানের বিস্তৃতি, যুক্তির ধার আমাকে মুগ্ধ করতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই তর্ক-বিতর্ক চলত। কখনও কখনও আমরা মতৈক্যে পৌঁছুতাম, কখনও কখনও মতানৈক্য থেকেই যেত। আমার সঙ্গে তাঁর 'বাহাস' (তাঁর ভাষায়) মুহিত সাহেব খুব উপভোগ করতেন। পরবর্তী কোনো এক সময়ে তিনি বেনুর বাবার কাছে আমার পড়াশোনার বিস্তৃতির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর মুখে অনবরত শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর প্রশংসা শোনা যেত।
মুহিত সাহেবের রসবোধ ছিল প্রখর। বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক সময়ে এমন সব রসাত্মক মন্তব্য করতেন যে হেসে গড়িয়ে পড়তাম। তাঁর গল্পের ঝুলিটিও ছিল বিরাট। তাঁর বিস্তৃত অভিজ্ঞতা সে ঝুলিকে আরও ঋদ্ধ করেছে।
কিছুদিন পরে বেনু যখন জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর মূল্যায়ন বিভাগে কাজ করত, তখন মুহিত সাহেব সেই বিভাগের পরামর্শক ছিলেন। বেশ কটি প্রকল্পের মূল্যায়নে ওঁরা দু'জন একসঙ্গে কাজ করতেন। বেনুকে তিনি খুব স্নেহ করতেন এবং ও অসুস্থ হলে পরে তিনি খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। নিউইয়র্কে তাঁর সঙ্গে বেশ দেখা হতো, কিন্তু তিনি ঢাকায় চলে এলে সে বাঁধন আলগা হয়ে যায়। তবু নানান জনের মাধ্যমে তাঁর খোঁজ-খবর করতাম, তিনিও আমাদের হাল-হকিকত জানতে চাইতেন।
মুহিত সাহেবের সঙ্গে শেষ দেখা হয় বেশ কবছর আগে। বেনু তখন প্রয়াত এবং আমি মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের কার্যভার গ্রহণ করেছি। ওই প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে ঢাকায় এলে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন তাঁর বাসভবন ছিল কামাল আতাতুর্ক সড়কের ওপরে। তাঁর ড্রইংরুমে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সে ঘরে বাতি কম ছিল এবং মোটা পর্দা টানা ছিল। তিনি ঘরে ঢুকেই অস্থির হয়ে তাঁর লোকজনকে বলতে লাগলেন, 'আরো বাতি জ্বালিয়ে দাও এবং সব পর্দা সরিয়ে দাও। আমি সেলিমকে একটু ভালো করে দেখি। ওকে আমি বহুদিন দেখি নি।' তাঁর সেই মমতা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছিল।
অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন সেদিন। খুব খুশি হয়েছিলেন আমি মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের হাল ধরেছি বলে। বেনুর কথা উঠেছিল অবশ্যাম্ভাবীভাবে। ওঁদের যৌথ কাজের সময়কার বহু গল্প বলেছিলেন, খোঁজ নিয়েছিলেন আমাদের কন্যাদের, জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের, বিশেষত জাতিসংঘের পরিপ্রেক্ষিতে। যখন চলে আসি, তখন প্রধান ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ভদ্রতা, সৌজন্য এবং সহৃদয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
না, তাঁর সঙ্গে আমার ভীষন নৈকট্য ছিল না, কিংবা তাঁর সঙ্গে আমার প্রায়শই দেখা হত, এমনও নয়, আমাকে তাঁর কাছের মানুষও বলা যাবে না। তবু প্রয়াত জনাব আবুল মা'ল আবদুল মুহিতের সঙ্গে আমার এমন এক মানবিক সম্পর্ক ছিল যাঁর উষ্ণতা, গভীরতা এবং মায়াময়তার সুবাস আমি হৃদয়ে অনুভব করি।
- সেলিম জাহান: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগসহ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
- [লেখাটি সেলিম জাহানের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত]