আমদানি পণ্যের বাড়তি মূল্যে ভর করে রাজস্বে ভালো প্রবৃদ্ধি
বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি পণ্যের শুল্ককর আদায় বেড়েছে, যা সরকারের রাজস্ব আদায়কে গত বছরের তুলনায় এবার অনেকটাই স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নিয়ে গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, গত মার্চে আগের মাসগুলোর তুলনায় রাজস্ব আদায়ে কিছুটা ভাটা পড়লেও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তো বটেই, গত পাঁচ বছরের একই সময়ের গড় প্রবৃদ্ধির তুলনায়ও বেশি।
তা সত্বেও স্বস্তিতে নেই এনবিআর। কেননা এই গতিতে রাজস্ব আদায় বাড়লে সরকারের চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না বলেই ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদ এমনকি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারাও।
এর মধ্যেই আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্যও এনবিআর অপেক্ষাকৃত বড় রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এনবিআরের রাজস্বে যে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তাতে মূল ভুমিকা রেখেছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এতে এনবিআরের কৃতিত্ব খুব বেশি নয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রাজস্বে যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তাতে এনবিআরের কৃতিত্বের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি বড় ভুমিকা রেখেছে।"
রাজস্বের পরিসংখ্যানও এমন কথাই বলছে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে আমদানি পর্যায়ের শুল্ককর আদায়ে, যা প্রায় ২১ শতাংশ। একই সময়ে ভ্যাট ও ইনকাম ট্যাক্স আদায় বেড়েছে যথাক্রমে ৯.৯৪ শতাংশ ও ১৪.০৯ শতাংশ।
তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, আমদানি ব্যয় যে হারে বেড়েছে আমদানি শুল্ক আদায় বরং সে হিসেবে আরও বেশি হারে আদায় হওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
তবে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোঃ আজিজুর রহমান বলেন, "চলতি অর্থবছরে প্রচুর পরিমাণে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। আমদানিকৃত এই পণ্যের ব্যবহার বেশি হয়েছে সরকারের বড় প্রকল্পগুলোতে।"
রাজস্ব আদায়ে ভালো গতি থাকা সত্বেও বর্তমান গতিতে রাজস্ব আদায় হলে জুন পর্যন্ত পরবর্তী তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে।
তবে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি জনিত চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া এনবিআরের জন্য আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, "তিনটি বিষয় আগামীতে এনবিআরের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। ইনফ্লেশনারি প্রেশার থেকে সাধারণ ভোক্তাকে ছাড় দেওয়া ছাড়াও এনবিআর যেসব ক্ষেত্রে ট্যাক্স অব্যাহতি দিয়ে রেখেছে, তা তুলে নিতে পারবে কিনা এবং কর ফাঁকি রোধ।"
অবশ্য সরকারের বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, চিনির মূল্যবৃদ্ধি জনিত চাপ থেকে কিছুটা রেহাই দিতে ইতোমধ্যে অনেকটা বাধ্য হয়ে এনবিআর ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে কিংবা কমিয়েছে। তা সত্বেও গত এক বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে ভোজ্যতেল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "গত দুই বছর ধরে সরকার কর্পোরেট করে বড় ছাড় দিয়েছে। এর বাইরেও কিছু খাতে ভ্যাট ট্যাক্স অব্যাহতি দিয়েছে। চিনি ও ভোজ্যতেলে ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতো।"
তিনি বলেন, অর্থবছরের শেষ দিকে এসে আদায় অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। সেই বিবেচনায় বর্তমানের প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রা হয়তো শেষ পর্যন্ত অর্জিত নাও হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা অবশ্য প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় না হওয়ার জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জকে মোটাদাগে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হল, এনবিআরের রিফর্ম এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পারা, কর ফাঁকি ধরতে না পারায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের ঘরে আনতে না পারা এবং বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ কর অব্যাহতি।