এলভিরা নাবিউলিনা: যুদ্ধকালীন রুশ অর্থনীতির গুরুভার যে নারীর কাঁধে
দৃঢ় প্রত্যয় আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার জন্য আর্থিক খাতে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। দ্বিধা বা সংশয় তাকে যেন আক্রান্তই করে না সহজে। ঠাণ্ডা মাথায় কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত এ নারী হলেন- এলভিরা সখিপজাদোভনা নাবিউলিনা। একাধারে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক- সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশার চেয়ারওম্যান, অর্থনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জ্যেষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১৯ সালের তালিকায় তিনি বিশ্বের ৫৩তম ক্ষমতাধর নারীও ছিলেন।
এলভিরার জন্ম ১৯৬৩ সালের ২৯ অক্টোবর, তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রদেশ রিপাবলিক অব বাশকোরতোরস্তানের রাজধানী উফা'য়। ভলগা নদী আর উরাল পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত এ অঞ্চলটি অধুনা রাশিয়ার অংশ।
যে রাষ্ট্রে জন্ম, এককালের পরাক্রমশালী সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই, চোখের সামনেই যার ভাঙন দেখেছেন ৫৮ বছরের এলভিরা। তাই অর্থনীতির পাঠ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেকথাও তার অজানা নয়।
সামনে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ দেখে ঘাবড়ে যাওয়াই আর দশটা মানুষের বৈশিষ্ট্য। এলভিরা নাবিউলিনা দেশের সংকটকালে অর্থনীতি পরিচালনার গুরুভার কাঁধে বিচলিত হয়েছেন- এমন কথা অবশ্য তার নিন্দুকেরাও খুব একটা বলতে পারে না।
আর হয়তো সেকারণেই ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সময়ে রুশ অর্থনীতি পরিচালনার ভার নাবিউলিনার হাতে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
কেনই বা করবেন না! এই চ্যালেঞ্জ যে এলভিরার দ্বিতীয়বারের। এবার নিয়ে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যেই দুই দুই বার সংকট কবলিত রুশ অর্থনীতির তরীকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার উত্তাল ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষার কাণ্ডারী হলেন তিনি।
এ দায়িত্ব এতটাই চাপের যেখানে মুহূর্তের অসতর্কতা রাশিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরের অন্ধকার যুগে। তিনি কঠিন পরীক্ষায় জিততে ভালোবাসেন, আর সেজন্যই ইউক্রেনে যুদ্ধের সময়ে তার ওপর পুতিনের আস্থা সহজেই বোধগম্য।
এলভিরার সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জটি আসে ২০১৪ সালে। এ সময় ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলে নিলে মস্কোর ওপর ক্ষুদ্ধ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। বহুবিধ নিষেধাজ্ঞার ঝাঁপি তারা রাশিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়। এলভিরা তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে সবে এক বছর পার করেছেন। এমন সময়েই তাকে নিতে হয় রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের দরপতনের সাথে সাথে উচ্চগতির মূল্যস্ফীতি সামলানোর মতো গুরুতর ভার।
বিচলিত না হয়ে নাবিউলিনা নিলেন সুদহার তীব্রভাবে বৃদ্ধির দৃঢ় সিদ্ধান্ত। এভাবে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি তার হাত ধরে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধাণীর আধুনিক যুগে পা রাখে। তবে সিদ্ধান্তটি ছিল রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এতে রাশিয়ার অর্থনীতি অনেকটা মন্থর হয়ে পড়ে, কিন্তু একইসাথে বাগে আনে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে এলভিরা নাবিউলিনার পরিচিতি ছড়ায়।
আর্থিক খাত স্থিতিশীল রাখা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ঋণ প্রবৃদ্ধি- এমন হাজারো জটিল চ্যালেঞ্জে ঘেরা পৃথিবীর তাবড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের নিজস্ব জগত। রাশিয়ার অর্থনীতি জ্বালানি তেলের দর ওঠানামার ওপর নির্ভর করে। দাম কম থাকলে ছেদ পড়ে বিকাশে। এমন একটি দেশের অর্থনীতিকে প্রচলিত আর্থিক নিয়মনীতির শাসনে তিনি যেভাবে বেঁধেছেন তাতে এ ব্যাংকারদের জগতে উদীয়মান তারকাখ্যাতি পান। তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ইউরোমানি ম্যাগাজিন বর্ষসেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে এলভিরার নাম উল্লেখ করে। এর তিন বছর পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তৎকালীন প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে সপ্রশংস সুরে বলেন, 'মিসেস নাবিউলিনা চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংকে সংগীতের মোহনীয় মূর্ছনায় রূপ দিতে পারেন'।
এত এত প্রশংসা যার ঝুলিতে, সেই নাবিউলিনাকে এবার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিনতম চ্যালেঞ্জটি নিতে হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধী পশ্চিমা দুনিয়া ও তাদের মিত্ররা মস্কোর ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আধুনিক যুগে কোনো দেশই এত এত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েনি।
বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞা ট্র্যাকিংয়ের ডেটাবেজ- ক্যাস্টেল্লুম ডটআই সূত্রে জানা যায়, গত ৮ মার্চ নাগাদ রাশিয়ার নতুন করে ২,৭৭৮টি নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমা দুনিয়া। তখন পর্যন্ত মোট নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা ছিল ৫,৫৩০। মার্চ ও এপ্রিলের পরের দিনগুলোয় আরো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইইউ ও আমেরিকা।
এত নিষেধাজ্ঞা ইরানকেও দেওয়া হয়নি। সন্ত্রাসবাদে মদতদানের অভিযোগ এবং পরমাণু কর্মসূচির কারণে তেহরানের ওপর গত এক দশকে ৩ হাজার ৬১৬টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো।
এই রুঢ় বাস্তবতায় রাশিয়ার অর্থনীতিকে গভীর অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা করতে হবে নাবিউলিনাকে। বিশ্ব অর্থনীতি থেকে রাশিয়ার আর্থিক খাত পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ঠেকানোর দায়িত্বও তার।
দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর্থিক খাতে বৈরী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। তার সেসব উদ্যম পুতিনের ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসন সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি কতোটা কমাতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এরমধ্যেই রাশিয়ান মুদ্রা রুবলকে চরম দরপতনের কিনারা থেকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় শক্তিশালী হওয়ার ক্ষেত্রে দিকপালের ভূমিকা রেখেছেন এলভিরা নাবিউলিনা। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর প্রায় এক-চতুর্থাংশ মূল্যমান হারায় রুবল। এসময় রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাওয়া রোধে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়। সেগুলো অনেকটাই আগ্রাসী রূপে হওয়ায় মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে আসে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা সংকট থেকে রক্ষা পায়।
গত এপ্রিলে রাশিয়ার পার্লামেন্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেয়ারওম্যান হিসেবে নাবিউলিনার মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বৃদ্ধি করেছে। এর আগে তাকে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের মনোনয়ন দিয়েছিলেন পুতিন।
আমেরিকার ওয়াশিংটন-ভিত্তিক একটি আর্থিক শিল্প গ্রুপ- ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সের উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ এলিনা রিবাকোভার মতে, "এলভিরা নাবিউলিনা রাশিয়ার আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ দিশারী। তিনি অপরিহার্য, পুনঃনিয়োগের ঘটনা তাই অনেকটাই প্রতীকী।"
যেমন বুনো উল, তেমনই বাঘা তেতুল- তার মহৌষধ
একজন সফল পরিচালকের বৈশিষ্ট্য সংকটকে সুযোগে রূপ দেওয়া। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া সংকটকে সেভাবেই সামলান এলভিরা। ওই সময় আমেরিকার উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সৌদি আরবের উৎপাদন সীমিত করতে না চাওয়ার দ্বৈত প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বড় দরপতনের শিকার হয়। কমে যায় রাশিয়ার তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত রাজস্ব। খাঁড়ার ওপর মড়ার ঘা হয় ক্রিমিয়া দখলের কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি।
ধস নামে রুবলের দরে। এই অবস্থায় প্রচলিত একটি উপায় হতে পারতো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একটি বিশাল অংশ ব্যয় করে মুদ্রাবাজারে রুবলের বিনিময় হারকে সমর্থনের উদ্যোগ। কিন্তু, এমন সমাধানের পথে না হেঁটে বরং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমকে কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি সুদহার ১৭ শতাংশের মতো উচ্চ মাত্রায় বাড়ান, যা আরো কয়েক বছর এমন উচ্চ অবস্থানেই ধরে রাখেন।
এই পুনঃসমন্বয় ছিল পীড়াদায়ক। এতে অর্থনীতি প্রায় দেড় বছর ধরে সংকুচিত হয়। তবে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে আসে সাফল্য। এসময় রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসে, যা ছিল এমনকী সোভিয়েত পরবর্তী সময়ের সর্বনিম্ন হার। এই অর্জন সম্ভব কয়েক বছর আগেও কেউ ভাবতেই পারেনি। এক কথায়, অসাধ্যকে সম্ভব করার এক ইস্পাত-দৃঢ় মানসিকতার এক নেতৃত্ব শক্তি এলভিরা।
লন্ডন বিজনেস স্কুলের অর্থনীতির অধ্যাপক রিচার্ড পোর্টেসের মতে, "তিনি আধুনিক যুগের আদর্শ কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের দৃষ্টান্ত। (আপৎকালে) যা করা দরকার ছিল, তিনি ঠিক তাই করেছেন। এমনকী তা করা রাজনৈতিক বিবেচনায় কঠিন হওয়ার পরও। বিকল্প পথও ছিল। যেমনটা তুরস্ক করেছে। সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করে চরম বিপর্যয়ের আবহ তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ; মূল্যস্ফীতিকে লাগামহীনভাবে বাড়তে দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসে যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।"
অর্থাৎ, নাবিউলিনা নিজেকে একজন সুদক্ষ ব্যবস্থাপক ও প্রশাসক হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিষয়ে যে নাক গলানো যথাযথ নয়- তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তারই নেতৃত্বে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশিয়ায় আধুনিকায়নের সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুষ্ঠু যোগাযোগ, মৌলিক সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণের সময়সীমা নির্ধারণ, নীতিনির্ধারণীর বিষয়ে দিকনির্দেশনা এবং বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকার বা বৈঠকের একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে রুশ অর্থনীতির একটি পরিচালক মেধাশক্তির সূতিকাগার হয়েছে সেন্ট্রাল ব্যাংক অব রাশিয়া। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের বেসরকারি খাতের সুদক্ষ অর্থনীতিবিদদের সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এসব কৃতিত্ব যদি নাবিউলিনাকে না দেওয়া হয়- তবে আর কারই বা প্রাপ্য হতে পারে!
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে