ফার্নিচার থেকে ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং: কাঠের জায়গা নিচ্ছে পার্টিকেল বোর্ড
স্বল্প খরচ, টেকসই এবং পরিবেশ বান্ধব হওয়ার কারণে কাঠের বিকল্প হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে প্যানেল বোর্ড বা পার্টিকেল বোর্ড।
বিভিন্ন অফিস ও বাসার ইন্টেরিয়র হিসাবে ব্যবহারের পাশাপাশি বাসার ফার্নিচার, দরজা ও দরজার ফ্রেম, পার্টিশন, ফলস সিলিং, তাক ও প্যানেলে ব্যবহার হচ্ছে এই বোর্ড। টেকসই এবং সহজে ডিজাইনযোগ্য হওয়ায় ফার্নিচার কোম্পানিগুলোও এখন নির্ভর করছে এ বোর্ডের ওপর।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঠ-বিকল্প আসবাবপত্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের বৈচিত্রের কারণে বাংলাদেশে পার্টিকেল বোর্ডের বাজার খুব দ্রুত বাড়ছে।
২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে এ শিল্পের বাজার।
বর্তমানে এ খাতে ১৫-২০টি বৃহৎ কোম্পানির অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। ছোট ছোট কোম্পানি রয়েছে ৩০০-র বেশি।
আর বার্ষিক বিক্রি ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন এ খাত-সংশ্লিষ্টরা।
বিপুল চাহিদার কারণে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিনিয়োগ নিয়ে আসছে এ খাতে। এর মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ আকিজ সম্প্রতি ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করে ময়মনসিংহের ত্রিশালে নির্মাণ করেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির পার্টিকেল বোর্ড কারখানা।
আকিজ গ্রুপের পরিচালক (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, পার্টিকেল বোর্ড অ্যান্ড সিরামিকস) খোরশেদ আলম বলেন, 'দ্বিতীয় প্লান্টে উৎপাদন শুরু করে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর আমরা এখন তৃতীয় প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা করছি। কাঠের ব্যবহার না করেও কাঠের চেয়ে ভালো ফার্নিচার হওয়ায় আগামীতে এ ইন্ডাস্ট্রির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।'
তিনি বলেন, তিনটি প্রেক্ষাপটে এ শিল্পের বিকাশ ইতিবাচক। প্রথমত, সুন্দর ডিজাইন ও টেকসই হওয়ার পরও এর ব্যয় কাঠের চেয়ে অনেক কম। দ্বিতীয়ত, এটি হলে গাছের ব্যবহার কমে পরিবেশের জন্য রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করছে।
তৃতীয়ত, পার্টিকেল বোর্ড বানাতে গাছের শাখা-প্রশাখা ব্যবহার হওয়ায় প্রান্তিক মানুষের আয়ের একটি অতিরিক্ত উৎস তৈরি হচ্ছে। মানুষ গাছ না কেটেই অতিরিক্ত শাখা-প্রশাখা কেটে বেচে দিতে পারছে।
পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদনের জন্য ত্রিশালে ১০০ একরের বেশি জমিতে ২০১৭ সালে এই দ্বিতীয় কারখানা গড়ে তোলে আকিজ। সম্পূর্ণ জার্মান প্রযুক্তিতে গড়া এ কারখানায় বছরে ২৫ কোটি বর্গফুট বোর্ড উৎপাদন করা যায়।
সারা দেশ থেকে ট্রাকে করে গাছের ডালপালা বা শাখা-প্রশাখা কিনে এনে কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই কারখানায় বর্তমানে সরাসরি কাজ করছে ২ হাজারের বেশি লোক।
খোরশেদ আলম বলেন, 'আমাদের দেশে প্রচলিত মেহগনি, রেইনট্রি, আকাশমনি ও চাম্বল গাছের শাখা-প্রশাখা আমাদের মূল কাঁচামাল। এগুলোকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এমন বোর্ড বানানো হয় যাতে কাঠের চেয়ে বেশি টেকসই হয়।'
দেশে পার্টিকেল বোর্ডের উৎপাদন শুরু হয় ১৯৬২ সালে, পারটেক্স গ্রুপের হাত ধরে। তখন পাট কাঠি দিয়ে বোর্ড বানাত প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৬ সালে দেশে প্রথম কাঠভিত্তিক পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদনও শুরু হয় পারটেক্সের মাধ্যমেই।
এরপর এ শিল্পে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে টিকে গ্রুপের সুপার বোর্ড, স্টার পার্টিকেল বোর্ড মিলস, সুপার পার্টিকেল বোর্ড মিলস, এমআরএস ইন্ডাস্ট্রিজ, অ্যাম্বার বোর্ডস, মাল্টি প্যানেলস, উডল্যান্ড প্লাইউড অ্যান্ড পার্টিকেল বোর্ড মিলস, বেঙ্গল প্লাইউড মিলস, অটবি, ডায়মন্ড পার্টিকেল বোর্ড মিলস এবং মায়া পার্টিকেল বোর্ড মিলসসহ বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
আর শ্রমঘন এ খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের।
কাঠের ব্যবহার না হলেও এই বোর্ড টেকসই উল্লেখ করে পার্টেক্স স্টার গ্রুপের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান মো. শিব্বির হোসেন বলেন, বিশেষ কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে এ কাঠে পোকা ধরে না।
'স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরা জুটেক্স বোর্ড রপ্তানিও করছি,' বলেন তিনি।
শিব্বির হোসেন আরও বলেন, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদিত হয়—যেমন মেলামাইন, প্লাই বোর্ড, প্লেইন বোর্ড, ভেনিয়ার্ড বার্ড ও পিভিসি বোর্ড। এমডিএফ বোর্ড মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হয়।
দেশের পার্টিকেল বোর্ডের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটায় স্থানীয় কোম্পানিগুলো, বাকি ২০ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে বছরে মোট ৮০ হাজার বর্গফুট পার্টিকেলের চাহিদা রয়েছে।
সামাজিক বনায়ন বাড়লে বিদেশ থেকে আমদানির পরিমাণ আরো কমে আসবে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পার্টিকেল বোর্ড শিল্প দ্রুত বড় হওয়ার কারণে কাঠের ব্যবহার ৬০ শতাংশ কমেছে বলেও তিনি জানান।
মোট পার্টিকেল বোর্ডের ৫৫ শতাংশ ব্যবহার হয় ফার্নিচার খাতে, বাকি ৪৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয় আবাসন ও কর্পোরেট খাতে।
ফার্নিচারের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার
গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহের পরিবর্তে বোর্ডকে কাঠ হিসাবে রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখছে দেশের ফার্নিচার কোম্পানিগুলো।
বোর্ডের ওপর লেকার বসিয়েও ফার্নিচার বানাচ্ছে প্রায় সব কোম্পানি।
বাজারে পাওয়া মালয়েশিয়ান বা কানাডিয়ান কাঠের ফার্নিচারের বড় অংশও স্থানীয় কাঠভিত্তিক বোর্ড থেকে বানানো বলে দাবি করেন আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলসের মার্কেটিং ম্যানেজার শাহরিয়ার জামান।
বাংলাদেশ ফার্নিচারস ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম এইচ রহমান বলেন, 'পার্টিকেল বোর্ড এখন ফার্নিচারের কাঁচামাল হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসাবে কাজ করছে। ফলে ফার্নিচার খাতের সাথে তাল মিলিয়ে পার্টিকেল বোর্ডের বাজার বাড়ছে।'