রিজার্ভ বাঁচাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণে সরকার, স্থগিত রাখা হবে বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয় এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত রাখাসহ নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
বুধবার এ তথ্য জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, "যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা প্রয়োজন এবং সেসব প্রকল্প এখনই বাস্তবায়ন না করলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সেগুলো আমরা ছয় মাস কিংবা আরও পরে বাস্তবায়ন করবো।"
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও কঠিন হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের উপরও। যতোদিন বহিঃখাতের এসব প্রভাব পুরোপুরি দূর না হবে, ততোদিন বাংলাদেশকেও এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে জানান মন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, "যেসব প্রকল্প এখনই বাস্তবায়ন করা না হলে অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সেগুলো আমরা পরে বাস্তবায়ন করবো। প্রকল্পগুলো বাতিল করা হচ্ছে না, শুধু বাস্তবায়নের সময় পিঁছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
বাস্তবায়ন জরুরি নয়, ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের এমন সব প্রকল্পের তালিকা চেয়ে ইতোমধ্যে সকল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এতে প্রকল্পগুলোর বর্তমান বাস্তবায়ন পরিস্থিতি, প্রকল্পে কী পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ ব্যয় করতে হবে, বিদেশি অর্থায়ন আছে কি-না, থাকলে তার পরিমাণসহ বিভিন্ন তথ্য চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এছাড়া, আগামীতে মন্ত্রণালয়গুলো কোন ধরনের এবং কি কি প্রজেক্ট গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সেগুলোতে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রয়োজন হবে, তার তথ্যও চেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
রপ্তানির তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়া, বছরজুড়ে রেমিটেন্স প্রবাহে নিম্নগতি, কোভিড সহায়তা ও বাজেট সাপোর্ট হিসেবে বিদেশি ঋণসহ অনুদান কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে, যা গত বছরের আগষ্টে ৪৮.৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। অবশ্য রমজান ও ঈদের কারণে গতমাসে রেমিটেন্স প্রবাহে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চলতি বছর শেষে যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করেছিল সরকার, তখন ধারাবাহিকভাবে তা কমতে থাকায় নীতি-নির্ধারকরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, বিদ্যমান রিজার্ভের মধ্যে ৭.২ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এ ব্যয় হবে, যা প্রকৃতপক্ষে রিজার্ভ নয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
সংস্থাটির মতে, কোনো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ওই দেশের ৩-৬ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান হলে তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে। বাংলাদেশ সব সময়ই ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর রিজার্ভ সংরক্ষণের নীতি বাস্তবায়ন করছে। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এবং রিজার্ভের পরিমাণ আরও কমে গেলে তা আর সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
গতবছর রিজার্ভ বাড়ার সময় ইডিএফ এ রিজার্ভ ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড গঠন করে পায়রা বন্দরসহ অবকাঠামো উন্নয়নখাতে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় করা শুরু করে সরকার।
কিন্তু রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়া ও রেমিটেন্স প্রবাহ কমার কারণে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকায় গত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই বাংলাদেশকে সতর্ক করে দেয় বিশ্বব্যাংক।
'অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের অধীনে বিনিয়োগ প্রকল্প অর্থায়ন এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সম্প্রসারণের মতো নন-মনেটারি উদ্দেশ্যে রিজার্ভের ব্যবহার বাংলাদেশের পুনর্বিবেচনা করা উচিত,' জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
ওই সময় এক্সচেঞ্জ রেটও শিথিল করার পরামর্শ দিয়েছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক মাল্টিলেটারাল সংস্থাটি। অবশ্য চলতি মাস থেকেই ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেটে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটছে।
গতমাসে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে দেউলিয়া ঘোষণার পর বাংলাদেশ অপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি মার্জিন বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার পর মঙ্গলবার তা আরেক দফা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এছাড়া, গাড়ি আমদানিতে এলজি মার্জিন ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করে বিলাসী পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।
এছাড়াও, ডলারের তুলনায় টাকার মান কমিয়েও আমদানি নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অর্থমন্ত্রী বলেন, "আমাদের বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে হয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। এই অস্বাভাবিক সময় ম্যানেজ করার জন্য যা করা প্রয়োজন, সরকার তা-ই করছে।"
"সময় যখন কঠিন, তখন আমাদেরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যতদিন বহির্বিশ্বে অস্থিরতা থাকবে ততদিন এ ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে এমন নয় যে, দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে, উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে," যোগ করেন তিনি।
বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকেই একমাত্র 'সমস্যা' উল্লেখ করে মুস্তফা কামাল বলেন, "বিশ্বজুড়ে কোভিড পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। যুদ্ধ কবে থামবে, তা কেউই বলতে পারবে না। যতোদিন এই পরিস্থিতি থাকবে, ততোদিন আমাদের এভাবেই সবকিছু রিস্ট্রাকচার করে চলতে হবে।"
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমাতে নতুন রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প আপাতত বাস্তবায়ন করা হবে না। ভবন নির্মাণ ও সংস্কার, বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত রাখা হবে।
"কোভিডের শুরুতে আমরা প্রকল্পগুলোর তিনটি তালিকা করেছিলাম। কম অগ্রাধিকার প্রকল্প, মাঝারি অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং অগ্রাধিকার প্রকল্প। এর মধ্যে কম অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রায় ২৪৭টি প্রকল্পে অর্থ ব্যয় স্থগিত করা হয়েছিল, মাঝারি অগ্রাধিকার প্রকল্পে শর্তসাপেক্ষে মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ ব্যায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকা পর্যালোচনা করে আমরা এখন নতুন তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি," বলেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১ হাজার ৮১৯টি অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে যার আনুমানিক ব্যয় ১৮ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করা হবে ১০ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হবে ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।
এ বছর ২ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য সরকারের নিজস্ব উৎস থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে এবং বিদেশি উৎস থেকে ৬৯ হাজার ৬০৪ আসবে। সরকারি তহবিল থেকে বৈদেশিক মুদ্রার জন্য ব্যয় করা হবে ৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি গাড়ি কেনা নিষিদ্ধ ছিল। চলতি অর্থবছর বরাদ্দের ৫০ শতাংশ গাড়ি কেনায় ব্যয় করা যাবে বলে আগেই জানিয়েছে অর্থবিভাগ।
এছাড়া কোভিডকালে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে মোট বরাদ্দের ৫০ শতাংশ কমানো হয়। ওই সময় বিভিন্ন দেশে লকডাউন ও ভিসা রিস্ট্রেকশনের কারণে এমনিতেও কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ অনেকটাই বেড়ে গেছে। অপ্রয়োজনীয় কাজে দলবেঁধে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণে অনুমোদন না দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, "এখন যে সফরগুলো হচ্ছে, সেগুলো আগে অনুমোদন দেওয়া ছিল। এখন থেকে আর বিদেশ সফরের ঢালাও অনুমোদন দেওয়া হবে না। নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তারা আর বিদেশ যেতে পারবে না। আপাতত বিদেশ সফর আর নয়।"
এদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো যৌক্তিক বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিসটিনগুয়িস্ট ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, "এ অবস্থায় আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর লাগাম টেনে ধরার বিকল্প নেই। তাই আমদানি নির্ভর প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন প্রলম্বিত করার সরকারি সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবিদার।"
সরকারের বেশ কিছু অগ্রাধিকার প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষের দিকে রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পাদেন স্বর্থে এ সব প্রকল্পে অর্থ প্রভাব ঠিক রাখতে হবে। তাছাড়া বাস্তবায়নের মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে এমন প্রকল্পগুলোর কাজ পিছিয়ে পড়লে ভবিষ্যতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি এমন প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রলম্বিত করার পরামর্শ দেন তিনি।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও সরকারের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলেন, "আমি কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই, কেন তারা যথাযথভাবে যোগ্যতা বিবেচনা না করে প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছে। যদি প্রকল্পগুলো প্রয়োজন অনুসারে নেওয়া হতো তবে বেশি অগ্রাধিকার বা কম অগ্রাধিকার প্রকল্প বলতে কিছু থাকতো না।"