সাগরিগায় নাঈম ঘূর্ণি, সাদা পোশাকে রঙিন প্রত্যাবর্তন
বাজে পারফরম্যান্সে দল থেকে বাদ। সিরিজ আসে, দলে ডাক পড়ে না। ডাক পড়লেও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয় না। হতাশা গিলে নিতে চায়, কিন্তু গা ঝারা দিয়ে অনুশীলনে নেমে পড়েন নাঈম হাসান। 'ওই তো আলোর পথ'- এমন বিশ্বাসকে সঙ্গী করে ঘাম ঝরিয়ে যান বাংলাদেশে ডানহাতি এই স্পিনার। দুই, চার মাস করে শেষ পর্যন্ত ১৫ মাস। অবশেষে ডাক এলো, ঘরের মাঠ চট্টগ্রামে মিললো খেলার সুযোগ। যেখানে পুনর্জন্ম হয়ে গেল নাঈমের। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করে সাদা পোশাকে ফেরার পর্বটা রঙিন করে রাখলেন তরুণ এই স্পিনার।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে চলমান প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষে দুটি নাম বড় করে লেখা। একজন নাঈম, শ্রীলঙ্কার ইনিংসের বাংলাদেশের সেরা বোলার। সাগরিকায় স্পিন ঘূর্ণিতে লঙ্কানদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন তিনি। আরেকটি নাম অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস; লঙ্কানদের প্রথম ইনিংসের কান্ডারী। এই দুজনের দিকেই ছিল সব আলো, তবে শেষটায় ম্যাথুসকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন নাঈম। তার স্পিন ছোবলেই টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছানো হয়নি লঙ্কান অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের, ফিরেছেন ১৯৯ রান করে।
দ্বিতীয় দিন লঙ্কানদের ইনিংস ওলট পালট করে দেওয়ার কাজটি এক হাতে করেছেন নাঈম। এক ওভারে দুই উইকেট তুলে নিয়ে সফরকারীদের দিক ভুলিয়ে দেন তিনি। এদিন তার ঝুলিতে উঠেছে আরও ২ উইকেট। এর আগে প্রথম দিন শ্রীলঙ্কার ইনিংসে প্রথম আঘাত হানেন নাঈম। পরে আরেকটি উইকেট নিয়ে দিন শেষে ঝুলিতে জমান ২ উইকেট। সব মিলিয়ে নাঈমের শিকার ৬ উইকেট, যা তার ক্যারিয়ার সেরা। এর আগে দুবার ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। ৬ উইকেট নিতে নাঈম বোলিং করেছেন ৩০ ওভার, ৩.৫০ ইকোনমিতে রান খরচা করেছেন ১০৫।
নাঈমের বোলিং দেখে মনে হয়নি ১৫ মাস আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন তিনি। প্রথম দিনের খেলা শেষে বাংলাদেশের স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ বলেছিলেন, 'সে ১৮ মাস ধরে টেস্ট খেলেনি, কিন্তু অনেক অনুশীলন করে যাচ্ছে। সেদিক থেকে তার আত্মবিশ্বাসের দরকার ছিল। প্রথম উইকেট পাওয়ার পরই সে সেটা পেয়ে যায়।' দ্বিতীয় দিন একের পর এক উইকেট তুলে নিয়ে কোচের কথার স্বার্থকতাই যেন প্রমাণ করেন চট্টগ্রামের এই ছেলে।
১৫ মাস আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা দুই টেস্টে নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন নাঈম। চট্টগ্রাম টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫০ ওভার করে ৫ উইকেট নিলেও খরুচে ছিলেন তিনি। কাইল মেয়ার্সের ইতিহাস গড়া ২১০ রানের ইনিংসে ক্যারিবীয়দের অবিশ্বাস্য সেই জয়ের ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে অনিয়ন্ত্রিত বোলিং করেন নাঈম।
যা বড় ইনিংস খেলার পথে মেয়ার্সের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এরপর মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসেও অনুজ্জ্বল থাকেন নাঈম। ২৪ ওভার বোলিং করে থাকেন উইকেটশূন্য। দ্বিতীয় ইনিংসে তিন উইকেট নিয়ে দল থেকে বাদ পড়া আটকাতে পারেননি। পরের সিরিজে বাদ পড়েন, তার নাম কাট পড়ে বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেও। এরপর বাংলাদেশ ৯টি টেস্ট খেললেও দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন নাঈম।
সেই নাঈম ঘরের মাঠে ফিরলেন রাজার মতো। সেটাও অবশ্য মেহেদী হাসান মিরাজের চোটের কারণে। না হলে হয়তো স্কোয়াডে ডাক মিললেও একাদশে সুযোগ হতো না। মিরাজের না থাকা দরের জন্য ধাক্কার হলেও নাঈমের কাছে তা সুযোগ হয়ে ধরা দিয়েছে। আর প্রথম সুযোগেই তিনি প্রমাণ করেছেন, এবার তিনি ভুল শুধরে প্রস্তুত হয়েই ফিরেছেন। যে প্রস্তুতি কেবল একটা টেস্টের জন্যই নয়, পরের ম্যাচগুলোতেও তাকে দলে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে রাখছে।
মাঝে ইনজুরিতে ছিলেন নাঈম। সে সময়ও ফেরার মিশন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি তিনি। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ দল যখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বগুড়াতে তখন বাংলা টাইগার্সের ক্যাম্পে ঘাম ঝরাচ্ছেন। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে নিজের পরিশ্রমের কথা জানিয়ে নাঈম বলেন, 'ইনজুরির সময়টায় নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। তখন দলের সঙ্গে ছিলাম আমি, খেলার সুযোগ হয়নি। মিরাজ ভাই খুব ভালো খেলছিলেন। ব্যাটিং, বোলিং ভালো করছিলেন, ওই জন্যই তো সুযোগ পাইনি। ইনজুরির সময় আমার চেষ্টা ছিল নিজেকে ধরে রাখার, অনুশীলন করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা, যেন যখন সুযোগ আসে, তখন ভালো খেলতে পারি। তখন আমি বিসিএল খেলছিলাম, এরপর তো আবার বিপিএল শুরু হলো। তারপর আবার বাংলাদেশ টাইগার্সের ক্যাম্পে চলে গিয়েছি। সব মিলিয়ে গ্যাপটা হয়নি '
স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথের কাছ থেকে নিয়মিতই শেখেন নাঈম। এ ছাড়া বাংলাদেশ টাইগার্সের কোচ সোহেল ইসলামের নিজের দুর্বলতার জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ স্পিনারের ভাষায়, 'হেরাথ লাইন-লেন্থের ব্যাপারে বলেছেন কীভাবে উন্নতি করা যায়। আমরা বাংলা টাইগার্সে ক্যাম্পে ছিলাম। তখন সোহেল স্যার ছিলেন। উনার সঙ্গে কাজ করেছি, কী কী উন্নতি দরকার। উনার সঙ্গে কাজ করে উন্নতির চেষ্টা করেছি। এখানে আসার পর ম্যাচ নিয়ে কথা বলেছিলেন যে, কী করতে হবে কোন পরিস্থিতিতে।'
২০১৮ সালে টেস্ট অভিষেক নাঈমের। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই নেন ৫ উইকেট, পরের ইনিংসে থাকেন উইকেটশূন্য। এরপর আরও ৭টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি, এর মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো পান ৫ উইকেট। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুঃস্বপ্নের সিরিজের পর ছিটকে গিয়ে লম্বা সময় ধরে ফেরার পথ খুঁজে যেতে হয়েছে তাকে। অবশেষে মিলেছে পথ, শুরুতেই সে পথ আলোকিত করেছেন তিনি। আলোকিত রেখেই নাঈম সে পথ ধরে এগোতে পারেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।