হোটেলে ভাতের দাম বাড়েনি, কিন্তু সবজি-ডিম-মাংসের দাম!
করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল দেশের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রভাব কমে আসলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করে সব খাতের পণ্যের দাম। বিশ্ববাজারের মতো এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও।
দামী দামী রেস্তোরাঁর পাশাপাশি খাবারের দাম বেড়েছে ভাতের হোটেলগুলোতেও। করোনার আগে ঢাকায় কোনো ভাতের হোটেলে ভাত, ডিম ও সবজি খেতে খরচ হতো কমবেশি ৩০-৩৫ টাকা। ভাত প্রতি প্লেট ১০ টাকা, ডিম একটি ১৫ টাকা এবং সবজি পাওয়া যেত ১০ থেকে ১৫ টাকায়। কিন্তু, খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে একই খাবার এখন খেতে হচ্ছে বেশি দামে। ভাতের দাম না বাড়লেও বেড়েছে এর ডিম, সবজিসহ মাংসের তরকারির দাম।
সম্প্রতি কারওয়ানবাজারে সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, কিচেন মার্কেটে মুরগির দোকানগুলোর উল্টোদিকের একটি ছোট হোটেলে ডিমভাজি খেতে ক্রেতাদের খরচ হচ্ছে ২০ টাকা। সাথে পরোটা নিলে বিল আসছে ৩০ টাকা। যেখানে করোনার আগে রুটি-পরোটার দাম ছিল ৫ টাকা প্রতি পিস। এখন পরোটার দাম বাড়লেও এর আকার ছোট হয়ে গেছে বলে জানান হোটেলে খেতে আসা কাস্টমাররা।
খাবারের দাম কেন বেশি রাখা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে হোটেলের বিক্রেতা মো. জলিল জানান, 'দেড়শ টাকার তেল এখন দুইশ টাকায় কিনতে হচ্ছে, ডিম, ময়দা সবকিছুর দামই বেড়েছে। আমাদের দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই।'
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বিশ্বের পরিবহন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, তেলসহ অন্যান্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধিসহ মুদ্রার অবমূল্যায়নে সৃষ্ট ইনফ্লেশনের প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারে।
ডিমের হালি যেখানে কিছুদিন আগে বেড়ে ৩৫ টাকা হয়েছিল, সেখানে এর দাম বর্তমানে রাখা হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা। ডজন কিনলে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা।
বেড়েছে সবজির দামও। কারওয়ান বাজারে বেগুন পাইকারি প্রতি কেজি ১৬ থেকে ২০, চিচিঙ্গা ১৫, ঢেঁড়শ ১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে এগুলোর প্রতি কেজি ৪০ টাকার কমবেশি দরে বিক্রি হতে দেখা যায় । কারওয়ান বাজারে কাঁচা মরিচ পাইকারি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি।
ডিম ও সবজির পাশাপাশি বেড়েছে পেঁয়াজ, রসুন ও ডালের দামও।
গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকায়। এছাড়া, দেশি রসুনের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে কেজিপ্রতি ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত সপ্তাহে মসুর ডাল প্রতি কেজি ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকায়।
পেঁয়াজ, রসুন, শাকসবজি, ডাল- হোটেলের সবজির তরকারিতে প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দামই যখন চড়া তখন হোটেলগুলোরও নিজেদের চলার জন্য খাবারের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
অন্যদিকে, ভাতের দাম এখনও না বাড়লেও সামনে যে বাড়বে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ঢাকার বাজারে নাজিরশাইল চালের দাম এখন ৬২ থেকে ৬৮ টাকা। মিনিকেট যেখানে কিছুদিন আগেই ৫৬-৫৮ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৮ টাকায়।
শুধু যে ভাতের হোটেলেই দাম বেড়েছে তা কিন্তু নয়, বেড়েছে বড় রেস্তোরাঁগুলোতেও। আগে একটি রাইস প্ল্যাটারের (ফ্রাইড রাইস, এক পিস ফ্রাইড চিকেন, চায়নিজ সবজি) দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা; যা এখন বিক্রি হয় ১৯০ থেকে ২২০ টাকায়।
প্ল্যাটারগুলোর দাম বাড়লেও কমেছে খাবারের পরিমাণ। একই মেন্যুর খাবারের দাম বাড়িয়ে ফ্রাইড রাইসের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি সাথে দেওয়া মুরগির পিসও এখন দেওয়া হয় ছোট সাইজের।
ঈদের দুই দিন পরে যে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ১৩০ টাকা ছিল সেই মুরগি এখন ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে । হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগান বাজারে ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, কারওয়ান বাজারে ১৪৫ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে দেখা যায়। এ বাজারে সোনালী মুরগী ২৮০ টাকা, কক মুরগি ২৬০ টাকা, আর দেশি মুরগি ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখে গেছে গরুর মাংস চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজিতে ও খাশির মাংস ৯০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ঈদের আগেও এ দামেই বিক্রি হয়েছে।
বাজারের এই অবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। এর মধ্যে, সরকার টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যের তেল, ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রির কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দিয়েও পরে তা বন্ধ করে দেয়।
আগে অন্তত ভাতের হোটেলে বেশি দামের মাংসের তরকারি বাদ দিয়ে ডিম দিয়ে খেলেও সেই স্বস্তিটাও এখন আর নেই।
এমনকি মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খরচ ও খাওয়ার খরচ কমিয়েছেন।
বেসরকারি চাকরিজীবী তৌহিদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে করে ভবিষ্যতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারে। যে কারণে বাসায় অতিরিক্ত ভাজাপোড়া পরিহার করে তেলের খরচ কমানো, যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই রান্না করা, তিন চার পদের খাবারের জায়গায় এক-দুই পদে নিয়ে আসার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছি।'