অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন: রপ্তানি কমবে, বাড়বে রেমিট্যান্স
কোভিড-পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ধারায় ফেরায় উচ্চগতিতে বাড়ছে দেশের রপ্তানি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পর তার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি গন্তব্যে মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা ও মন্দা পরিস্থিতি। এ কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশে নেমে যাবে বলে প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
রপ্তানি কমে যাওয়ায় কারণে কাঁচামাল আমদানি প্রবৃদ্ধিও ৩০ শতাংশ থেকে কমে ১২ শতাংশে নামবে বলে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে প্রাক্কলন করেছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের প্রেক্ষাপটে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেও আমদানি প্রবৃদ্ধিতে লাগাম পড়বে।
তবে চলতি অর্থবছরজুড়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে থাকা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে নতুন অর্থবছরে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ শ্রমিক নতুন করে বিদেশে যাওয়ায় তাদের কাছ থেকে বাড়তি এই পরিমাণ রেমিট্যান্স পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশের বেশি।
রপ্তানি কমবে?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশি পণ্যের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে মূল্যস্ফীতির বাড়ছে রেকর্ড হারে। এর ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাকি দুই মাস মে ও জুনে এসব বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খেতে পারে।
চলতি মাসের ২৫ দিনে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য পোশাক থেকে আয় এসেছে প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিল মাসের একই সময়ের তুলনায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার কম বলে জানাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস বিভাগের হালনাগাদ তথ্য।
অবশ্য চলতি মাসে ঈদের কারণে এক সপ্তাহের বেশি সময় ছুটি ছিল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের মে মাসে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি করেছিল ২.৫৫ বিলিয়ন ডলারের। ওই মাসেও ঈদের ছুটি ছিল। চলতি মাসের ঈদের ছুটির সময় বাদ দিয়ে বাকি দিনগুলোতে পোশাক রপ্তানির ধারা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাস শেষে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় হয়তো কিছুটা প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু গত আট মাসের মতো প্রবৃদ্ধির গতি থাকবে না।
গত সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আট মাসে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এবং গড় প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ।
কিন্তু দেশের পোশাক কারখানা মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গত মাসগুলোর মতো আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির এই গতি থাকবে না।
দেশের গ্রিন সনদপ্রাপ্ত শীর্ষ আরএমজি কারখানাগুলোর একটি, প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ফজলুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত কয়েক মাসে যে গতিতে রপ্তানি হচ্ছিল, জুন মাস থেকে তা থাকবে না বলে মনে করি। ইতিমধ্যে ওয়ার্ক অর্ডারের ফ্লো স্লো-ডাউন হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি রিসেশনের পদধ্বনি রয়েছে।'
এমন পরিস্থিতিতে মানুষ খাবার ও জ্বালানির জন্য ব্যয় ঠিক রেখে পোশাকের মতো পণ্য ক্রয় কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
'ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে এই মূল্যস্ফীতি যদি চলতে থাকে, তাহলে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে,' বলেন তিনি।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার। সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। আগামী অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০ বিলিয়ন ডলার।
করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে, ২০১৮-২০২১ মেয়াদি রপ্তানি নীতি আদেশে ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। কিন্তু মহামারির কারণে আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ কম হয়েছে। তখনকার বিজিএমইএ নেতারা বলেছিলেন, এই লক্ষ্যমাত্রার ৫০ বিলিয়ন ডলার শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকেই আয় করা সম্ভব হবে।
নতুন রপ্তানি নীতি আদেশে ২০২৪ সালের মধ্যে ৮০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা জানান, কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে পশ্চিমা বিশ্বে ভোক্তাদের চাহিদা বাড়ছিল। অন্যদিকে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে কিছু কার্যাদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হওয়ায় দেশের রপ্তানিও বাড়ছিল।
কিন্তু গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি। সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আমদানি বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। ফলে বিশ্বব্যাপী শুরু হয় মূল্যস্ফীতি। সহসা এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আভাসও মিলছে না।
বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, গত চার দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। এছাড়া ইউরোপের অনেক দেশেই এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ব্র্যান্ড টার্গেট কর্প-এর বরাত দিয়ে বলা হয়, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে নাকাল আমেরিকানরা। এ কারণে গত মার্চের শুরুতে হুট করেই টার্গেট কর্পের বিক্রি কমে যায়।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাজুয়াল পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাওয়ায় খুচরা পর্যায়ে পোশাকের চাহিদাও কমে গেছে।
কোনো কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও ফের বিশ্বমন্দার আশঙ্কার কথা বলছে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে সেখানকার ভোক্তার ব্যয় কমবে, যাতে বাংলাদেশের রপ্তানি খানিকটা কমতে পারে।
এছাড়া বিগত মাসগুলোর মতো প্রবৃদ্ধির হার না-ও থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
'তবে চীনে লকডাউনসহ বিভিন্ন কারণে চীন সঠিকভাবে সাপ্লাই দিতে না পারায় পোশাকের অর্ডার বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে। ফলে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না,' যোগ করেন এমএ রাজ্জাক।
রেমিট্যান্স নিয়ে বড় আশা সরকারের
করোনা মহামারির সময় ২০২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে ৩৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়ায় চলতি অর্থবছরের বাজেটেও এ খাতে বড় প্রবৃদ্ধি আশা করেছিল সরকার।
কিন্তু ঈদ-উল-ফিতরের আগে গত এপ্রিলে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছাড়া অর্থবছরের বাকি ৯ মাসই রেমিট্যান্সে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল।
তবে আগামী জুলাইয়ে ঈদ-উল-আযহার আগে প্রবাসীদের কাছ থেকে বাড়তি রেমিট্যান্স পাওয়ার আশায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি অর্থবছর শেষে ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে দেশে। ২০২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৭.৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে হলে চলতি মে ও আগামী জুন মাসে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাহের দরকার হবে। প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী ২০২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্সে ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২৯ বিলিন ডলার।
২০২১ অর্থবছরে দেশে ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে।
আগামী অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৮৮ বিলিয়ন ডলার ছোঁয়ার প্রাক্কলন
চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭৩.৪৩ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে ৬০.৬৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে আমদানিতে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তাতে বছর শেষে আমদানির পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল ৬৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই পুরো বছরের প্রাক্কলনের তুলনায় আমদানিতে ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে।
মূলত জ্বালানি, সারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর ১০ মাসে কম পণ্য আমদানি করেও বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে আমদানিতে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৭৯ বিলিয়ন ডলার। আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রাক্কলন অনুযায়ী ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
অর্থাৎ সরকারের বাজেট প্রাক্কলন অনুযায়ী আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে আগামী অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১১.৭৪ বিলিয়ন ডলারে
রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানির তুলনায় আমদানি প্রবৃদ্ধি কম হলেও নতুন অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ বড় অঙ্কেরই হবে বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের হিসাবে, আগামী অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৫৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যালান্স অভ পেমেন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির ২.৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি ধরা হয়েছিল জিডিপির ০.০৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৪৫৮.৫ বিলিয়ন ডলার, আর ব্যালান্স অভ পেমেন্টে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১১.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫১২.৪ বিলিয়ন ডলার। ওই বছর ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দাঁড়াবে ৮ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী এ বছরের জুনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকবে ৪২ বিলিয়ন ডলার, যা আগামী বছরের জুনে বেড়ে হবে ৪৩.৫০ বিলিয়ন ডলার।