পিরু মিস্ত্রির হাত ধরে যেভাবে শুরু ঢাকার কফিন ব্যবসা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পার্শ্ববর্তী চানখারপুলে কফিন ব্যবসা শুরু করেন একজন কাঠমিস্ত্রি। মূলত ময়নাতদন্ত ব্যবস্থা ও দূরে লাশ পরিবহন শুরুর পরই প্রয়োজন পড়তে থাকে তার কফিনের। পুরান ঢাকার এ বাসিন্দা পরিচিত ছিলেন 'পিরু মিস্ত্রি' নামে। পরবর্তীতে তার পরিবারের হাত ধরেই বড় হয়েছে রাজধানীর কফিন ব্যবসা। এখনও চানখারপুল ও কাঁটাবনে যে কয়টি কফিনের দোকান আছে তার সবকয়টির মালিক পিরু মিস্ত্রির বংশধররা।
তবে এখন আর কফিন ও দাফন সামগ্রী ব্যবসায় আগের রমরমা নেই। ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স আর পলিথিন ব্যাগের দাপটে ক্রমাগত লোকসান গুনছেন ব্যবসায়ীরা। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসা গুটিয়ে নিবেন বলেও জানান পিরু মিস্ত্রির বংশধররা।
কাঁটাবনের ভার্সিটি মার্কেটের 'আল বিদায় স্টোর' এর কর্ণধার মনির হোসেনের কাছ থেকে জানা যায়, এ ব্যবসায় তাদের পথচলা ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে।
কফিন ব্যবসা ও পিরু মিস্ত্রির পরিবার
২০ বছর আগেও ঢাকার কফিন ব্যবসায় একক আধিপত্য ছিল পিরু মিস্ত্রির পরিবারের। মনির হোসেন দাবি করেন, কাফনের কাপড়ের ব্যবসা তো বহুকাল ধরেই চলছে। তবে কফিন ব্যবসা বেশিদিনের না। পিরু মিস্ত্রিই (ঢাকায়) প্রথম এ ব্যবসা শুরু করেন।
তবে পিরু মিস্ত্রির পাঁচ ছেলের কেউই এ ব্যবসায় আসেননি। তার মেয়ের ঘরের নাতি মো. সাদেক হোসেন ভার নেন ব্যবসার।
একসময় পুরো ঢাকায় কফিন সরবরাহ করতেন সাদেক হোসেন। চানখারপুলে অবস্থিত তার দোকানে কর্মী ছিল ১২-১৫ জন। কোন বিপর্যয় ছাড়া সাধারণ দিনেও বিক্রি হয়েছে ৬০-৭০টি কফিন। দোকানের নাম ছিল 'চিরবিদায় স্টোর'।
রাজধানীতে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী কফিন ব্যবসায় পথিকৃৎ হিসেবে নেন সাদেক হোসেনের নাম। তবে তার পুত্র মনির জানান, পিরু মিস্ত্রির কথা।
সাদেক হোসেন জীবিত থাকতেই কফিন ব্যবসায় জড়ান তার পাঁচ ছেলে। বড় ছেলে মো. ছাবের এ ব্যবসা করেই জীবন কাটিয়েছেন। বর্তমানে তিনিও বেঁচে নেই৷
প্রায় ২৫ বছর আগে কাঁটাবন ভার্সিটি মার্কেটে দোকান কেনেন সাদেকের দ্বিতীয় ছেলে- মনির হোসেন। যে দোকান এখনও চলে বর্তমান 'আল বিদায় স্টোর' নামে। তার ছোট তিন ভাই- মো. করিম, মো. বেলাল ও মো. আজিজ দোকান নেন একই মার্কেটে। নাম 'চিরবিদায় স্টোর'।
সাদেক হোসেন মারা যান ২০০৭ সালে। তার মৃত্যুর পর চানখারপুলের 'বিসমিল্লাহ বিদায় স্টোর' এর দায়িত্বে আছেন তারই মেয়ের ঘরের নাতি সাহেল পিয়াস।
কেমন চলছে ব্যবসা ?
প্রশ্নটি করতেই মনির হোসেনের চেহারায় দেখা যায় একরাশ হতাশা। কফিন ব্যবসা কফিনে যাওয়ার সময় হয়েছে বলে জানান তিনি। মনির হোসেন বলেন, '২০১০ সালেও আমার ছয়-সাত জন কর্মচারী ছিলো। দিনে ১৫-২০টা কফিন ও দাফন সামগ্রী বিক্রি হতো। এখন দিনে অনেক সময় একটাও বিক্রি হয় না।' একই কথা জানান 'চিরবিদায় স্টোর' এর কর্মী কাবুল মিয়াও।
এমন অবস্থার পেছনে কারণ হিসেবে মনির কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন। তিনি জানান, একসময় পুরো ঢাকায় কফিন বিক্রি করতাম আমরা। আমাদের মিস্ত্রিরাই এখন মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে দোকান দিয়েছে। কোন দুর্ঘটনায় একসঙ্গে অনেক কফিনও দরকার হয়। তখন মর্গ থেকে আমাদের কাছে চাইলেও যোগান দিতে পারি না কর্মচারী স্বল্পতা ও পর্যাপ্ত কাঠ মজুদ না থাকায়। তবে কাঠমিস্ত্রিদের এমন সমস্যা নেই। তাই আমরা অর্ডার পাই কম। এ ছাড়া বিক্রি কমে যাওয়ায়, বেশি মিস্ত্রি রাখারও সুযোগ নেই। এসময় নিজে কফিন তৈরি না শেখার আফসোসের কথাও শোনান মনির হোসেন।
তবে এ অবস্থার জন্য বড় কারণ হিসেবে তিনি ফ্রিজিং গাড়িগুলোর কথা বলেন। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ফ্রিজারে করেই মরদেহ নিয়ে যায়। আর যাদের সামর্থ্য নেই- তাদের অনেকেই কিছু সামাজিক সংগঠন থেকে কফিন ফ্রি পান।
বর্তমানে আল বিদায় স্টোরে মনিরের ছেলে আবির হোসেন ও তার খালাতো ভাই আসাদুজ্জামান বসেন। নিজে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ 'পাঠাও' চালান মনির। কিছুদিনের মধ্যে দোকান বিক্রি করা হবে বলে জানান তিনি।
একই অবস্থা চিরবিদায় ষ্টোরেরও। বড় দোকানকে দুই ভাগ করে এক অংশকে করা হয়েছে পাখির দোকান। চিরবিদায় ষ্টোরের ভেতরেও আছে পাখির দোকানের মালামাল। এ দোকানটিও বিক্রি করার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে চানখারপুলের দোকানটি। সেখানের কর্মচারী রবিউল আউয়াল বলেন, খুব বেশি লাভ নেই, সমান সমান থাকে। মালিক পিয়াস তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অবশ্য একটা বাইক সার্ভিসিং দোকানও পরিচালনা করেন।
কোথায় কোথায় বিক্রি হয় কফিন ?
রাজধানীতে মোট ছয়টি পাইকারি দোকান আছে কফিনের। সেগুলো মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, আদাবর, তালতলা, কামরাঙ্গির চর, পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়িতে অবস্থিত।
এ ছাড়া খুচরা বিক্রেতা আছে প্রায় ৩৫-৪০ জন। চানখারপুল ও কাঁটাবন ছাড়াও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, মিরপুর-১, আগারগাঁও, মিরপুর-১০, শ্যাওড়াপাড়া, মগবাজার, বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও, উত্তরা, জুরাইন, কোনাপাড়া ও ধোলাইপাড়ে কফিন বিক্রি হয়।
অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানান, শুধু কফিন বা দাফন সামগ্রী বিক্রি করে সংসার চলে না। প্রায় সবাই অন্য কোন উপার্জনের মাধ্যম বের করেছেন।
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাইকারি দোকানের মিস্ত্রি আবুল বাশার কাজ করছেন ২০১৩ সাল থেকে। এক সময় মাসে ৩৫০টা পর্যন্ত কফিন তৈরি করলেও, এখন বানান ১২০-১৫০ টি। তাই এখন পাশাপাশি পুরাতন ফার্নিচারের ব্যবসা করেন তিনি।
মিরপুর-১০ নম্বরের শেষ বিদায় স্টোরের মালিক হুমায়ুন কবিরের খোঁজে গিয়ে দেখা যায়, 'তিনি রিক্সার চাকা মেরামত করছেন। প্রশ্নের উত্তরে জানান, কফিন ব্যবসায় পোষায় না। তাই কিছু না কিছু করতেই হয়।'
এ ব্যবসায় প্রতারণা নেই বলে জানান হুমায়ুন। কফিন বিক্রির তিনবছর পরও বাকি অর্থ ফেরত পাওয়ার নজির আছে বলে জানান তিনি। বলেন, 'প্রিয় মানুষের বিদায় বেলায় কেউ প্রতারণা করে না।'
যে কাঠ দিয়ে তৈরি হয় কফিন, কি কি থাকে দাফনের প্যাকেজে
কফিন তৈরিতে নির্দিষ্ট কোন কাঠের প্রয়োজন হয় না। তবে ক্রেতারা বেশি টাকায় কিনতে চান না বলে সাধারণত কড়ই কাঠ ব্যবহার করা হয়। প্রায় সব জায়গাতেই এ কাঠের কফিনের দাম পড়ে হাজার থেকে ১২০০ টাকার কাছাকাছি। কাঠ কেনা হয় কামরাঙ্গিরচর স'মিল থেকে।
তবে খ্রিষ্টান বা ধনীরা নেন দামি কফিন। যেগুলো তৈরি হয় সেগুন বা কেরোসিন কাঠ দিয়ে। কাঠ ভেদে দাম পড়ে ৫-১০ হাজার টাকা। বছরে এক কিংবা দুটি কফিন বিক্রি হয় এ ধরনের।
কাফনের কাপড় ও দাফন সামগ্রীও বিক্রি হয় দোকানগুলোতে। কাপড়ের মান ও পুরুষ বা নারী ভেদে দাম হয় ভিন্ন। মান ভেদে কাপড়ের দাম পড়ে ১৮০০- ৪২০০ পর্যন্ত। নারীদের কাফনের কাপড় বেশি লাগে, তাই দাম আরও ২০০-৩০০ টাকা বেশি থাকে।
দাফন ও গোসলের প্যাকেজগুলোতে থাকে ৯ ধরনের জিনিস। আগরবাতি, সাবান, কর্পূর, সুরমা, আতর, দাঁত খিলাল, তুলা ও ব্লেড। প্যাকেজের দাম পড়ে ৩০০-৫০০ টাকা।
এছাড়া লাশ বেশি সময় কফিনে রাখতে হলে ভেতরে দেওয়া হয় চা পাতা। যার মাধ্যমে দূর করা হয় গন্ধ। ৫-১০ কেজি চা পাতা প্রয়োজন হয় প্রতি কফিনে। পাঁচ কেজি চা পাতার দাম নেওয়া হয় চার-পাঁচশ' টাকা।
কফিন বিক্রির অধিকাংশ দোকানেই একটা বিষয় মিল আছে, নামে 'বিদায়' শব্দটি থাকা। এভাবে চললে হয়তো আরও একটি বিষয়ে মিল থাকতে পারে, ব্যবসাকে 'চিরবিদায়' বলা। যেমনটা বিদায় নিয়েছেন টাইপরাইটাররা।