বগুড়ায় ট্রান্সজেন্ডার হোচিমিনের পরিবার ২ মাস ধরে একঘরে
বগুড়ার সদরের বারোপুর এলাকায় পাঁচ পরিবারকে একঘরে রাখা হয়েছে। এই পরিবারের মধ্যে এক পরিবারে ট্রান্সজেন্ডার নারী আছেন, তাকে কেন্দ্র করেই ঘটনার সূত্রপাত বলে দাবি করা হচ্ছে।
ঘটনাটি সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের বারোপুর তালুকদার পাড়ার। গত মার্চের শেষের দিক থেকে এই পাঁচ পরিবারকে একঘরে করে রাখা হয়।
ট্রান্সজেন্ডার ওই নারীর নাম হোচিমিন ইসলাম, তিনি কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন। তার বাবা নজরুল ইসলাম বাবলু মারা গেছেন ৯ বছর আগে। বারোপুরের এই গ্রামের বাড়িতে এখন তার মা রেহেনা খাতুন ও বোন নিলুফা ইয়াসমিন থাকেন। নিলুফার দুই সন্তান স্থানীয় একটি স্কুলে পড়াশোনা করে।
হোচিমিনের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হোচিমিন ট্রান্সজেন্ডার নারীতে রূপান্তরিত হওয়ায় সম্প্রতি তার চাচা তাদের সম্পত্তির ভাগ চান। এই বিষয় নিয়ে গ্রামের লোকজনের সাথে বৈঠকও হয়েছে। জমির ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্বেই একঘরে করে রাখার সূত্রপাত।
২০২০ সালে ট্রান্সজেন্ডারে রুপান্তরিত হন হোচিমিন। এরপর বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। হোচিমিন বলেন, পরে আমাকে নিয়ে, আমার মা-বোনকে নিয়ে গ্রামে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তিমূলক কথা বলতে থাকেন স্থানীয়রা। এর মধ্যে চাচা রেজাউল তালুকদার জমির ভাগ চেয়ে বসেন।
তিনি আরও জানান, গত মার্চে রেজাউল করিম আমার মাকে বলেন, 'তোমার তো এখন দুটাই মেয়ে। তাহলে নিয়ম অনুসারে, ভাইয়ের অবর্তমানে আমি সম্পত্তির ভাগ পাব।'
হোচিমিনের পরিবারের দাবি, এই জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রেজাউল তাদের হুমকি দেওয়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে হোসিমিন থানায় জিডি করেন। গত ১৩ মার্চ থানায় তাদের ডেকে আপোষ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে গত শবে বরাতের দিন। ওই দিন স্থানীয়রা জমায়েত হন। রেজাউলকে থানায় ডাকার অভিযোগে হোচিমিনের পরিবারের উপর ক্ষিপ্ত হন। এই আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পাড়ার কেউ তাদের কথা বলতে পারবে না।
এ সময় হোচিমিনের চাচা রেজাউল করিম, সাবেক ইউপি সদস্য আহসান হাবীব হারুন, রাহিজুল ইসলাম তালুকদার, খায়রুল, শাহিনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
হোচিমিনের বোন নিলুফা ইয়াসমিনের স্বামী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে রয়েছেন। মা একা থাকায় নিলুফা বাবার বাড়িতে বসবাস করছেন।
নিলুফা বলেন, শবে বরাতের দিন ওই ঘোষণার পর থেকে আমাদের পরিবারে ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি হয়। যারা আমাদের একঘরে করেছেন, তাদের বাড়ির মেয়েরা সকাল-বিকাল গালি দিতে থাকে। সব সময় তারা হোচিমিনকে নিয়ে আমাদের দোষারোপ করতে থাকে। আমার সন্তানদের সঙ্গেও অন্য বাচ্চাদের খেলাধুলা করতে দেয় না।
'আমরা এলাকার দোকান থেকে কোনো কিছু কিনতে পারি না। পাড়ায় দুটো দোকান রয়েছে; তারা আমাদের কাছে কিছু বিক্রি করে না। প্রয়োজনীয় যা কিছু কেনার বাড়ি থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরের ঘোড়াধাপ অথবা শহরের রাজা বাজার থেকে কিনতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'তাদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদেরকেও একঘরে করেছে গ্রামের ওই ক্ষমতাসীনরা। এখন আমরা নিরাপত্তা নিয়ে বেশি শঙ্কিত। তারা তো কথায় কথায় মেরে ফেলার হুমকিও দেন।'
এলাকায় খোঁজ নিয়ে 'একঘরে' করার বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। জানা যায়, রমজান মাসে তাদের বাড়িতে দুধ বিক্রি করা বন্ধ করা হয়েছিল। দোকানদারেরা কোনো কিছু বিক্রি করেনি তাদের কাছে।
এই একঘরে করার বিষয়ে পাড়ায় শবে বরাতের পর আরও একবার বৈঠক হয়েছিল। সে সময় এটা নিয়ে হোচিমিনের মা ও বোন প্রতিবাদ করলে উত্তপ্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়। তখন হোচিমিন ঢাকা থেকে ৯৯৯ এ ফোন করে বিষয়টি জানালে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশ দেখে বৈঠকের সবাই উঠে চলে যায়।
পরে পুলিশের পরামর্শে আবার থানায় জিডি করা হয়। এ নিয়ে ১১ মে পুলিশ দুই পক্ষকে থানায় ডেকে আবার আপোষ করে দেয়। কিন্তু, এলাকায় এসেই আবার আগের রুপে ফিরে যায় অভিযুক্তরা।
হোচিমিনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও আপোষে সাক্ষী দেওয়ার জন্য আরও চার বাড়ির মানুষদের আলাদা করে দেয় হারুন, খায়রুল, রাহিজুল তালুকদারসহ স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী।
এই ভুক্তভোগীরা হলেন, আতাউর রহমান, শাজাহান আলী তালুকদার, লুৎফর রহমান দুদু, ইমরুল হোসেন ও তাদের পরিবার।
ইমরুল হোসেনের স্ত্রী নাদিরা জানান, আপোষ থেকে ফেরার পরের দিন তাদের বাড়ির বর্জ্য পানি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এখনও পানি বের হতে দেয় না। আতাউরের বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। পরে সেটি ঠিক করা হয়েছে।
শাহাজান আলী তালুকদার বলেন, এর শুরু হয় হোচিমিনকে নিয়ে। ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার দোহাই দিয়ে তাদের এ এলাকা থেকে চলে যেতে বলা হত। এটা শুরু করে তার চাচা রেজাউল। পরে সে থেমে গেলেও হারুন, রাহিজুল, খায়রুলরা ওদের হুমকি-ধামকি দিতেই থাকে। এরা তো সবাই একই গোষ্ঠীর, পাশাপাশি বাড়ির।
সম্পর্কে হোচিমিনের দাদা শাজাহান আলী জানান, বাপ মরা এই দুজনের হয়ে কথা বলায়, থানায় আপোষে সাক্ষী হওয়ায় আমাকেও এক ঘরে করেছে। দোকানে আমাদের সদাই-পাতিও কিনতে বারণ করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় এক দোকানি লিটনের সাথে। তিনি জানান, 'আমি দোকানদার। কেউ কিছু কিনতে আসলে দিব না কেন? আসলে ওরাই কিছু কিনতে আসে না। ওরা কারও সাথে কথা বলে না। আমার ভাইয়ের ছেলের আকিকার মাংস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর মা (রেহেনা খাতুন) নেয়নি।
লিটন আরও বলেন, এখানে হোচিমিনের পরিবারের লোকজন-ই সমাজের সাথে যোগাযোগ করবে না বলে জানিয়েছেন।
এ সময় লিটনের সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা চুমকি আক্তার জানান, তাদের তো একঘরে করছেই ওর চাচারা। এটা অস্বীকার করার কী আছে।
চুমকি জানান, হোচিমিন আর তিনি একইসঙ্গে স্কুলে পড়েছেন। এলাকার মাতব্বর পরিচয়ের এই লোকেরা সব সময় ওকে হিজড়া বলে হেয় করে। তার পরিবারকেও হিজড়ার বাড়ি বলে গালমন্দ করে।
যাদের বিরুদ্ধে একঘরে করার অভিযোগ মূলত তারাও স্বীকার করেছেন বিষয়টি। তাদের মধ্যে একজন হলেন রাহিজুল তালুকদার। সম্পর্কে তিনিও হোচিমিনের চাচা।
রাহিজুলের বক্তব্য, 'এটি একটি পারিবারিক ব্যাপার। এর মধ্যে এক বৈঠকে হোচিমিনের মা বলেন, তোরা আমাদের কী টিকি (একঘরে) করবি। আমরাই তোদের টিকি করে দিলাম। কিন্তু, আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই।'
অভিযোগের বিষয়ে হোচিমিনের চাচা রেজাউল করিম তালুকদার বলেন, 'গত মার্চ মাসে গ্রামে কথা উঠল আমাকে কেন থানায় নিয়ে গেল ওদের পরিবার। গ্রামে কেন বিচার চাইল না? এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত; এই কারণে তাদের আলাদা করা হয়েছে। আর এক সময় তাদের কাছে জমি পাওয়ার দাবি করেছিলাম। কিন্তু আত্মীয় মনে করে ভাগ চাইনি। কোনো সমস্যা হবে না বলে থানায় মুচলেকাও দিয়েছি।'
আহসান হাবীব হারুনের কাছে জানতে চাইলে বলেন, 'একঘরে তো আমি করিনি। ওরাই তো কোনো কিছু হলে থানায় জিডি, অভিযোগ করে। আমরা থানায় গিয়েছিও এ বিষয়ে। এসব কারণেই মহল্লাবাসী তাদের একঘরে করেছে। আমার একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়।'
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, 'হোচিমিনের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ অবগত। এর আগেও তাদের আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও দেওয়া হবে। তবে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়টি পুলিশ দেখে না। এটি আদালতের বিষয়। আইনশৃঙখলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে পুলিশ সেখানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।'